পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOO 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অবষ্ণু খাওয়ার পরেই ফের্মি অন্তে আস্তে উপরে চলয় গেল, আলবাবু তাঙ্ক লক্ষ N r আজ সভাস্থলে- নলিনাক্ষ— যিনি বক্তৃতা করিয়াছিলেন, তাহাকে দেখিতে আশ্চর্য তরুণ এবং সুকুমার ; যুবাবয়সেও যেন শৈশবের অন্নান লাবণ্য র্তাহার মুখশ্ৰীকে পরিত্যাগ করে নাই ; অথচ র্তাহার অন্তরাত্মা হইতে যেন একটি ধ্যানপরতার গান্তীর্য র্তাহার চতুর্দিকে বিকীর্ণ হইতেছে। র্তাহার বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ক্ষতি'। তিনি বলিয়াছিলেন, সংসারে যে ব্যক্তি কিছু হারায় নাই সে কিছু পায় নাই। আমনি যাহা আমাদের হাতে আসে তাহাকে আমরা সম্পূর্ণ পাই না ; ত্যাগের দ্বারা আমরা যখন তাহাকে পাই তখনই যথার্থ তাহা আমাদের অন্তরের ধন হইয়া উঠে। যাহা-কিছু আমাদের প্রকৃত সম্পদ তাহা সম্মুখ হইতে সরিয়া গেলেই যে ব্যক্তি হারাইয়া ফেলে সে লোক দূৰ্ভাগ; বরঞ্চ তাহাকে ত্যাগ করিয়াই তাহাকে বেশি করিয়া পাইবার ক্ষমতা মানবচিত্তের আছে। যাহা আমার যায় তাহার সম্বন্ধে যদি আমি নত হইয়া করজোড় করিয়া বলিতে পারি। “আমি দিলাম, আমার ত্যাগের দান, আমার দুঃখের দান, আমার অশ্রুর দান- তবে ক্ষুদ্র বৃহৎ হইয়া উঠে, অনিত্য নিত্য হয় এবং যাহা আমাদের ব্যবহারের উপকরণমাত্র ছিল তাহা পূজার উপকরণ হইয়া আমাদের অন্তঃকরণের দেবমন্দিরের রত্নভাণ্ডারে চিরসঞ্চিত হইয়া থাকে । এই কথাগুলি আজ হেমনলিনীর সমস্ত হৃদয় জুড়িয়া বাজিতেছে। ছাদের উপরে নক্ষত্রদীপ্ত আকাশের তলে সে আজ স্তব্ধ হইয়া বসিল। তাহার সমস্ত মন আজ পূৰ্ণ ; সমস্ত আকাশ, সমস্ত জগৎসংসার তাহার কাছে আজ পরিপূর্ণ। বক্তৃতাসভা হইতে ফিরিবার সময় যোগেন্দ্ৰ কহিল, “অক্ষয়, তুমি বেশ পত্রটি সন্ধান করিয়াছ যা হােক। এ তো সন্ন্যাসী ! এর অর্ধেক কথা তো আমি বুঝিতেই পারিলাম না।” অক্ষয় কহিল, “রোগীর অবস্থা বুঝিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিতে হয়। হেমনলিনী রমেশের ধ্যানে মগ্ন আছেন ; সে ধ্যান সন্ন্যাসী নহিলে আমাদের মতো সহজ লোকে ভাঙাইতে পরিবে না । যখন বক্তৃতা চলিতেছিল তখন তুমি কি হেমের মুখ লক্ষ্য করিয়া দেখ নাই ?” যোগেন্দ্র। দেখিয়াছি বৈকি। ভালো লাগিতেছিল তাহা বেশ বুঝা গেল। কিন্তু বক্তৃত ভালে লাগিলেই যে বক্তাকে বরমাল্য দেওয়া সহজ হয়, তাহার কোনো হেতু দেখি না। অক্ষয়। ঐ বক্তৃতা কি আমাদের মতো কাহারও মুখে শুনিলে ভালো লাগিত ? তুমি জান না যোগেন্দ্ৰ, তপস্বীর উপর মেয়েদের একটা বিশেষ টান আছে। সন্ন্যাসীর জন্য উমা তপস্যা করিয়াছিলেন, কালিদাস তাহা কাব্যে লিখিয়া গেছেন । আমি তোমাকে বলিতেছি, আর যে-কোনো পাত্ৰ তুমি খাড়া করিবে হেমনলিনী রমেশের সঙ্গে মনে মনে তাহার তুলনা করিবে ; সে তুলনায় কেহ । টিকিতে পরিবে না। নলিনাক্ষ মানুষটি সাধারণ লোকের মতোই নয় ; ইহার সঙ্গে তুলনার কথা মনেই | উদয় হইবে না। অন্য কোনো যুবককে হেমনলিনীর সম্মুখে আনিলেই তোমাদের উদ্দেশ্য সে স্পষ্ট বুঝিতে পরিবে এবং তাহার সমস্ত হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিবে। কিন্তু নলিনাক্ষকে বেশ একটু কৌশল করিয়া যদি এখানে আনিতে পার তাহা হইলে হেমের মনে কোনো সন্দেহ উঠিবে না ; তাহার পরে ক্ৰমে শ্রদ্ধা হইতে মাল্যদান পর্যন্ত কোনোপ্রকারে চালনা করিয়া লইয়া যাওয়া নিতান্ত শক্ত হইবে না। যোগেন্দ্র। কৌশলটা আমার দ্বারা ভালাে ঘটিয়া ওঠে না— বলটাই আমার পক্ষে সহজ। কিন্তু যাই বল পাত্রটি আমার পছন্দ হইতেছে না । অক্ষয়। দেখো যোগেন, তুমি নিজের জেদ লইয়া সমস্ত মাটি করিয়ো না। সকল সুবিধা একত্রে · পাওয়া যায় না। যেমন করিয়া হােক, রমেশের চিন্তা হেমনলিনীর মন হইতে না তাড়াইতে পারিাণ আমি তো ভালো বুঝি না। তুমি যে গায়ের জোরে সেটা করিয়া উঠিতে পরিবে, তাহা মনেও করিয়ে না। আমার পরামর্শ অনুসারে যদি ঠিকমত চল তাহা হইলে তোমাদের একটা সদগতি হইতেও পারে। যোগেন্দ্র। আসল কথা, নলিনাক্ষ আমার পক্ষে একটু বেশি দুর্বোিধ। এরকম লোকদের লইয় কারবার করিতে আমি ভয় করি । একটা দায় হইতে উদ্ধার হইতে গিয়া ফের আর-একটা দায়ের মধ্যে