পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি Oo A বড়ো কথা বলিয়া আসিয়াছি বলিয়া আপনারা আমাকে মন্ত একটা গভীর লোক মনে করবেন না। সেদিন ছাত্ররা নিতান্ত ধরিয়া পড়িয়াছিল বলিয়া বক্তৃতা করিতে গিয়াছিলাম— অনুরোধ এড়াইবার ক্ষমতা আমার একেবারেই নাই—কিন্তু এমন করিয়া বলিয়া আসিয়াছি যে, দ্বিতীয় বার অনুরুদ্ধ হইবার আশঙ্কা আমার নাই। ছাত্ররা স্পষ্টই বলিতেছে, আমার বক্তৃতা বারো-আনা বােঝাই যায় নাই। যোগেনবাবু, আপনিও তো সেদিন উপস্থিত ছিলেন- আপনাকে সতৃষ্ণনয়নে ঘড়ির দিকে তাকাইতে দেখিয়া আমার হৃদয় যে বিচলিত হয় নাই, এ কথা মনে করিবেন না।” যোগেন্দ্ৰ কহিল, “আমি ভালো বুঝিতে পারি নাই সেটা আমার বুদ্ধির দোষ হইতে পারে, সেজন্য আপনি কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ হইবেন না।” অন্নদা। যোগেন, সব কথা বুঝিবার বয়স সব নয়। নলিনাক্ষ । সব কথা বুঝিবার দরকারও সব সময়ে দেখি না। অন্নদা। কিন্তু নলিনবাবু, আপনাকে আমার একটা কথা বলিবার আছে। ঈশ্বর আপনাদিগকে কাজ করাইয়া লইবার জন্য পৃথিবীতে পাঠাইয়াছেন, তাই বলিয়া শরীরকে অবহেলা করিবেন না। যাহারা দাতা তীহাদের এ কথা সর্বদাই স্মরণ করাইতে হয় যে, মূলধন নষ্ট করিয়া ফেলিবেন না, তাহা হইলে দান করিবার শক্তি চলিয়া যাইবে । নলিনাক্ষ । আপনি যদি আমাকে কখনো ভালো করিয়া জানিবার অবসর পান। তবে দেখিবেন, আমি সংসারে কোনো-কিছুকেই অবহেলা করি না । জগতে নিতান্তই ভিক্ষুকের মতো আসিয়াছিলাম, বহুকষ্ট বহুলোকের আনুকূল্যে শরীর-মন অল্পে অল্পে প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে। আমার পক্ষে এ নবাবি শোভা পায় না যে, আমি কিছুকেই অবহেলা করিয়া নষ্ট করিব। যে ব্যক্তি গড়িতে পারে না সে ব্যক্তি ভাঙিবার অধিকারী তো নয় । অন্নদা। বড়ো ঠিক কথা বলিয়াছেন। আপনি কতকটা এই ভাবের কথাই সেদিনকার প্রবন্ধেও বলিয়াছিলেন । যোগেন্দ্র। আপনারা বসুন, আমি চলিলাম— একটু কাজ আছে। নলিনাক্ষ । যোগেনবাবু, আপনি কিন্তু আমাকে মাপ করবেন । নিশ্চয় জানিবেন, লোককে অতিষ্ঠ করা আমার স্বভাব নয়। আজ নাহয় আমি উঠি । চলুন, খানিকটা রাস্তা আপনার সঙ্গে যাওয়া যাক । যোগেন্দ্র। না না, আপনি বসুন। আমার প্রতি লক্ষ করবেন না। আমি কোথাও বেশিক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারি না । অন্নদা। নলিনাক্ষবাবু, যোগেনের জন্য আপনি ব্যস্ত হইবেন না। যোগেন এমনি যখন খুশি আসে যখন খুশি যায়, উহাকে ধরিয়া রাখা শক্ত । যোগেন্দ্ৰ চলিয়া গেলে অন্নদাবাবুজিজ্ঞাসা করিলেন, “নলিনবাবু, আপনি এখন কোথায় আছেন ?” নলিনাক্ষ হাসিয়া কহিল, “আমি যে বিশেষ কোথাও আছি তাহা বলিতে পারি না। আমার জনাশুনা লোক অনেক আছেন, তাহারা আমাকে টানাটানি করিয়া লইয়া বেড়ান। আমার সে মন্দ লাগে না। কিন্তু মানুষের চুপ করিয়া থাকারও প্রয়োজন আছে। তাই যোগেনবাবু আমার জন্য আপনাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িতেই স্থান করিয়া দিয়াছেন। এ গালিটি বেশ নিভৃত বটে।” এই সংবাদে অন্নদাবাবুবিশেষ আনন্দপ্রকাশ করিলেন। কিন্তু তিনি যদি লক্ষ্য করিয়া দেখিতেন তো দেখিতে পাইতেন যে, কথাটা শুনিবামাত্র হেমনলিনীর মুখ ক্ষণকালের জন্য বেদনায় বিবৰ্ণ হইয়া গৈল। ঐ পাশের বাসাতেই রমেশ ছিল। ইতিমধ্যে চা তৈরির খবর পাইয়া সকলে মিলিয়া নীচে চা খাইবার ঘরে গেলেন। অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, নলিনবাবুকে এক পেয়ালা চা দাও।” নলিনাক্ষ কহিল, “না অন্নদাবাবু, আমি চা গ্লইব না।” অন্নদা। সে কি কথা নলিনবাবু! এক পেয়ালা চা- নাহয় তো কিছু মিষ্টি খান। নলিনাক্ষ। আমাকে মাপ করিবেন।