পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OSO রবীন্দ্র-রচনাবলী উচ্চমঞ্চে চড়িয়া বসেন আমার পক্ষে ঢেলা না মারিয়া তঁহাদের নাগাল পাইবার কোনো সম্ভাবনা নাই । আমার মতো এমন অসংখ্য লোক আছে, অতএব আপনি যদি সকলকে ছাড়িয়া কোনো অদ্ভুতলোকে উধাও হইয়া যান। তবে আপনাকে অসংখ্য ঢেলা খাইতে হইবে । নলিনাক্ষ । ঢেলা যে নানা রকমের আছে। কোনোটা বা স্পর্শ করে, কোনোটা বা চিহ্নিত করিয়া যায়। যদি কেহ বলে, লোকটা পাগলামি করিতেছে, ছেলেমানুষি করিতেছে, তাহাতে কোনো ক্ষতি করে না ; কিন্তু যখন বলে, লোকটা সাধুগিরি-সাধকগিরি করিতেছে, গুরু হইয়া উঠিয়া চেলা-সংগ্রহের চেষ্টায় আছে, তখন সে কথাটা হাসিয়া উড়াইবার চেষ্টা করিতে গেলে যে পরিমাণ হাসির দরকার হয় সে পরিমাণ অপৰ্যাপ্ত হাসি জোগায় না । যোগেন্দ্র। কিন্তু আবার বলিতেছি, আমার উপরে রাগ করবেন না নলিনবাবু। আপনি ছাদে উঠিয়া যাহা খুশি করুন, আমি তাহাতে আপত্তি করিবার কে ? আমার বক্তব্য কেবল এই যে, সাধারণের সীমানার মধ্যে নিজেকে ধরিয়া রাখিলে কোনো কথা থাকে না । সকলের যেরকম চলিতেছে আমার তেমনি চলিয়া গেলেই যথেষ্ট ; তার বেশি চলিতে গেলেই লোকের ভিড় জমিয়া যায় । তাহারা গালি দিক বা ভক্তি করুক, তাহাতে কিছু আসে যায় না ; কিন্তু জীবনটা এইরকম ভিড়ের মধ্যে কাটানো কি আরামের ? নলিনাক্ষ । যোগেনবাবু, যান কোথায় ? আমাকে আমার ছাদের উপর হইতে একেবারে সর্বসাধারণের শান-বাধানো একতলার মেঝের উপর সবলে হঠাৎ উত্তীৰ্ণ করিয়া দিয়া পালাইলে চলিবে কেন ? X যোগেন্দ্র। আজকের মতো আমার পক্ষে যথেষ্ট হইয়াছে, আর নয়। একটু ঘুরিয়া আসি গে। যোগেন্দ্ৰ চলিয়া গেলে পর হেমনলিনী মুখ নত করিয়া টেবিল-ঢাকার ঝালরগুলির প্রতি অকারণে উপদ্রব করিতে লাগিল। সে সময়ে অনুসন্ধান করিলে তাহার চক্ষুপল্লবের প্রান্তে একটা আৰ্দ্ধতার লক্ষণও দেখা যাইত । হেমনলিনী দিনে দিনে নলিনাক্ষের সহিত আলাপ করিতে করিতে আপনার অন্তরের দৈন্য দেখিতে পাইল এবং নলিনাক্ষের পথ অনুসরণ করিবার জন্য ব্যাকুলভাবে ব্যগ্ৰ হইয়া উঠিল। অত্যন্ত দুঃখের সময় যখন সে অন্তরে-বাহিরে কোনো অবলম্বন খুঁজিয়া পাইতেছিল না, তখনই নলিনাক্ষ বিশ্বকে তাহার সম্মুখে যেন নূতন করিয়া উদঘাটিত করিল। ব্ৰহ্মচারিণীর মতো একটা নিয়মপালনের জন্য তাহার মন কিছুদিন হইতে উৎসুক ছিল- কারণ, নিয়ম মনের পক্ষে একটা দৃঢ় অবলম্বন ; শুধু তাঁহাই নহে, শোক কেবলমাত্র মনের ভাব-আকারে টিকিতে চায় না, সে বাহিরেও একটা কোনাে কৃচ্ছসাধনের মধ্যে আপনাকে সত্য করিয়া তুলিতে চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত হেমনলিনী সেরূপ কিছু করিতে পারে নাই, লোকচক্ষুপাতের সংকোচে বেদনাকে সে অত্যন্ত গোপনে আপনার মনের মধ্যেই পালন করিয়া আসিয়াছে। নলিনাক্ষের সাধনপ্রণালীর অনুসরণ করিয়া আজ যখন সে শুচি আচার ও নিরামিষ আহার গ্রহণ করিল তখন তাহার মন বড়ো তৃপ্তিলাভ করিল। নিজের শয়নঘরের মেজে হইতে মাদুর ও কাপেট তুলিয়া ফেলিয়া বিছানাটি এক ধারে পদার দ্বারা আড়াল করিল ; সে ঘরে আর-কোনো জিনিস রাখিল না । সেই মেজে প্রত্যহ হেমনলিনী স্বহস্তে জল ঢালিয়া পরিষ্কার করিতে- একটি রেকবিতে কয়েকটি ফুল থাকিত ; স্নানান্তে শুভ্ৰবস্ত্ৰ পরিয়া সেইখানে মেজের উপরে হেমনলিনী বসিত ; সমস্ত মুক্ত বাতায়ন দিয়া ঘরের মধ্যে অবারিত আলোক প্রবেশ করিত এবং সেই আলোকের দ্বারা, আকাশের দ্বারা, বায়ুর দ্বারা সে আপনার অন্তঃকরণকে অভিষিক্ত করিয়া লইত । অন্নদাবাবু সম্পূর্ণভাবে হেমনলিনীর সহিত যোগ দিতে পারিতেন না ; কিন্তু নিয়মপালনের দ্বারা হেমনলিনীর মুখে যে-একটি পরিতৃপ্তির দীপ্তি প্রকাশ পাইত তাহা দেখিয়া বৃদ্ধের মন স্নিগ্ধ হইয়া যাইত। এখন হইতে নলিনাক্ষ আসিলে হেমনলিনীর এই ঘরেই মেজের উপরে বসিয়া তাহদের তিন জনের মধ্যে আলোচনা চলিত । যোগেন্দ্ৰ একেবারে বিদ্রোহী হইয়া উঠিল- “এ-সমস্ত কী হইতেছে ? তোমরা যে সকলে মিলিয়া