পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি VSS d রমেশ অপ্রতিভ হইয়া একটুখানি হাসিল। যোগেন্দ্ৰ পথের মধ্যে অনর্গল বকিয়া স্বাক্টস্স্ লাগিল ; বুলি, “যিনিই যাই বলুন, বিধাতাকে আমরা কেহই চিনিতে পারি নাই। তিনি আমাকে শহরের মধ্যে মানুষ করিয়া এতবড়ো শাহরিক করিয়া তুলিলেন, সে কি এই ঘোর পাড়াগীয়ের মধ্যে আমার জীবাত্মাটাকে একেবারে মাঠে মারিবার জন্য ?” রমেশ চারি দিকে তাকাইয়া কহিল, “কেন, জায়গাটি তো মন্দ নয়।” যোগেন্দ্র। অর্থাৎ ? রমেশ । অর্থাৎ, নির্জনযোগেন্দ্র। এইজন্য আমার মতো আরো একটি জনকে বাদ দিয়া এই নির্জনতা আর-একটু বাড়াইবার জন্য আমি অহরহ ব্যাকুল হইয়া আছি। রমেশ । যাই বল, মনের শান্তির পক্ষেযোগেন্দ্র। ও-সব কথা আমাকে বলিয়ো না- কয়দিন প্রচুর মনের শান্তি লইয়া আমার প্রাণ একেবারে কণ্ঠাগত হইয়া আসিয়াছে। আমার সাধ্যমত এই শান্তি ভাঙিবার জন্য ত্রুটি করি নাই। ইতিমধ্যে সেক্রেটারির সঙ্গে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইয়াছে। জমিদার-বাবুটকেও আমার মেজাজের যে-প্রকার পরিচয় দিয়াছি সহজে তিনি আমার উপরে আর হস্তক্ষেপ করিতে আসিবেন না। তিনি আমাকে দিয়া ইংরাজি খবরের কাগজে র্তাহার নাকিবি করাইয়া লইতে ইচ্ছুক ছিলেন- কিন্তু আমার ইচ্ছা স্বতন্ত্র, সেটা আমি তাকে কিছু প্রবলভাবে বুঝাইয়া দিয়াছি। তবু যে টিকিয়া আছি সে আমার নিজগুণে নয়। এখানকার জয়েন্টসাহেব আমাকে অত্যন্ত পছন্দ করিয়াছেন ; জমিদারটি সেইজন্য ভয়ে আমাকে বিদায় করিতে পারিতেছেন না। যেদিন গেজেট দেখিব, জয়েন্ট বদলি হইতেছেন সেইদিনই বুঝিব, আমার হেডমাস্টারি-সূৰ্য বিশাইপুরের আকাশ হইতে অস্তমিত হইল। ইতিমধ্যে এখানে আমার একটিমাত্র আলাপী আছে, আমার পাঞ্চকুকুরটি। আর-সকলেই আমার প্রতি যেরূপ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছে তাহাকে কোনোমতেই শুভদৃষ্টি বলা চলে না । যোগেন্দ্রের বাসায় আসিয়া রমেশ একটা চৌকিতে বসিল । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “না, বসা নয় । আমি জানি প্ৰাতঃস্নান নামে তোমার একটা ঘোরতর কুসংস্কার আছে, সেটা সারিয়া এসো। ইতিমধ্যে আর-এক বার গরম জলের কাৎলিটা আগুনে চড়াইয়া দিই। আতিথ্যের দোহাই দিয়া আজ দ্বিতীয় বার চা খাইয়া লইব ।” এইরূপে আহার আলাপ ও বিশ্রামে দিন কাটিয়া গেল । রমেশ যে বিশেষ কথাটা বলিবার জন্য এখানে আসিয়াছিল যোগেন্দ্ৰ সমস্ত দিন তাহা কোনোমতেই বলিবার অবকাশ দিল না। সন্ধ্যার পরে আহারান্তেকেরোসিনের আলোকে দুই জনে দুইকেদারা টানিয়া লইয়া বসিল । অদূরে শৃগাল ডাকিয়া গৈল ও বাহিরে অন্ধকার রাত্রি ঝিল্লির শব্দে স্পন্দিত হইতে লাগিল । রমেশ কহিল, “যোগেন, তুমি তো জােনই, তোমাকে কী কথা বলিতে আমি এখানে আসিয়াছি। একদিন তুমি আমাকে যে প্রশ্ন করিয়াছিলে সে প্রশ্নের উত্তর করিবার সময় তখন উপস্থিত হয় নাই। আজ আর উত্তর দিবার কোনো বাধা নাই ।” এই বলিয়া রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে ধীরে ধীরে সে আগাগোড়া সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। মাঝে মাঝে তাহার স্বর রুদ্ধ হইয়া কণ্ঠ কম্পিত হইল, মাঝে মাঝে কোনো কোনো জায়গায় সে দুই-এক মিনিট চুপ করিয়া রহিল। যোগেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া স্থির হইয়া শুনিল । যখন বলা হইয়া গেল তখন যোগেন্দ্র একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “এই সকল কথা যদি সেদিন বলিতে, আমি বিশ্বাস করিতে পারিতাম না।” রমেশ । বিশ্বাস করার হেতু তখনো যেটুকু ছিল, এখনাে তাঁহাই আছে। সেজন্য তোমার কাছে শামীর এই প্রার্থনা যে, আমি যে গ্রামে বিবাহ করিয়াছিলাম সে গ্রামে একবার তোমাকে যাইতে ইব । তাহার পর সেখান হইতে কমলার মাতুলালয়েও লইয়া যাইব । যোগেন্দ্র । আমি কোনোখানে এক পা নড়িব না, আমি এই কেদারাটার উপরে অটল হইয়া বসিয়া