পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২২ ) রবীন্দ্র রচনাবলী অক্ষয়। নিকটেই কাশীতীর্থ। সেখানে আমাদের একটি পরম বন্ধু আছেন ; এমনও হইতে পারে, কমলা তাহদের কাছে গিয়া আশ্রয় লইয়াছে। খুড়া আশান্বিত হইয়া কহিলেন, “কই, তঁহাদের কথা তো রমেশবাবু আমাদের কখনো বলেন নাই। যদি জানিতাম, তবে কি খোজ করিতে বাকি রাখিতাম ?” অক্ষয়। তবে একবার চলুন-না, আমরা দুইজনেই কাশী যাই। পশ্চিম-অঞ্চল আপনার সমস্তই জানাশোনা আছে, আপনি ভালো করিয়া খোজ করিতে পরিবেন। খুড়া এ প্রস্তাবে উৎসাহের সহিত সম্মত হইলেন। অক্ষয় জানিত তাহার কথা হেমনলিনী সহজে বিশ্বাস করিবে না, এইজন্য প্রমাণিক-সাক্ষীর স্বরূপে খুড়াকে সঙ্গে করিয়া কাশীতে গেল । 8br শহরের বাহিরে ক্যান্টনমেন্টের অধিকারের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অন্নদাবাবুরা একটি বাংলা ভাড়া করিয়া বাস করিতেছেন । অন্নদাবাবুরা কাশীতে পৌঁছিয়াই খবর পাইলেন, নলিনাক্ষের মাতা ক্ষেমংকরীর সামান্য জ্বরকাশি ক্ৰমে ন্যুমোনিয়াতে দাড়াইয়াছে। জ্বরের উপরেও এই শীতে তিনি নিয়মিত প্ৰাতঃস্নান বন্ধ করেন নাই বলিয়া তাহার অবস্থা এরূপ সংকটাপন্ন হইয়া উঠিয়াছে। কয়েক দিন অশ্রান্তযত্নে হেম তাহার সেবা করার পর ক্ষেমংকরীর সংকটের অবস্থা কাটিয়া গেল । কিন্তু তখনো তঁহার অতিশয় দুর্বল অবস্থা। শুচিতা লইয়া অত্যন্ত বিচার করাতে পথজল প্রভৃতি সম্বন্ধে হেমনলিনীর সাহায্য তঁহার কোনো কাজে লাগিল না। ইতিপূর্বে তিনি স্বপাক আহার করিতেন, এখন নলিনাক্ষ স্বয়ং। তাহার পথ্য প্ৰস্তুত করিয়া দিতে লাগিল এবং আহার সম্বন্ধে মাতার সমস্ত সেবা নলিনাক্ষকে স্বহস্তে করিতে হইত। ইহাতে ক্ষেমংকরী সর্বদা আক্ষেপ করিয়াবলিতে লাগিলেন, “আমি তো গেলেই হত, কেবল তোদের কষ্ট দিবার জন্যই আবার বিশ্বেশ্বর আমাকে বঁাচাইলেন ।” ক্ষেমংকরী নিজের সম্বন্ধে কঠোরতা অবলম্বন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার চারি দিকে পারিপাট্য ও সৌন্দর্যবিন্যাসের প্রতি তাহার অত্যন্ত দৃষ্টি ছিল। হেমনলিনী সে কথা নলিনাক্ষের কােছ হইতে শুনিয়াছিল। এইজন্য সে বিশেষ যত্নে চারি দিক পরিপটি করিয়া এবং ঘর-দুয়ার সাজাইয়া রাখিত এবং নিজেও যত্ন করিয়া সাজিয়া ক্ষেমংকরীর কাছে আসিত। অন্নদা ক্যান্টনমেন্টে যে বাগান ভাড়া করিয়াছিলেন সেখান হইতে প্রত্যহ ফুল তুলিয়া আনিয়া দিতেন, হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর রোগশয্যার কাছে সেই ফুলগুলি নানা রকম করিয়া সাজাইয়া রাখিত । নলিনাক্ষ মাতার সেবার জন্য দাসী রাখিতে অনেক বার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তাহাদের হস্ত হইতে সেরা গ্ৰহণ করিতে কোনোমতেই তাহার অভিরুচি হইত না। অবশ্য, জল তোলা প্রভৃতির জন্য চাকর-চাকরানি ছিল বটে, কিন্তু তাহার একান্ত নিজের কাজগুলিতে বেতনভুক কোনো চাকরের হস্তক্ষেপ তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। যে হরির মা ছেলেবেলায় তাহাকে মানুষ করিয়াছিল। সে মারা গিয়া অবধি অতি বড়ো রোগের সময়েও কোনো দাসীকে তিনি পাখা করিতে বা গায়ে হাত বুলাইতে দেন নাই। r সুন্দর ছেলে, সুন্দর মুখ তিনি বড়ো ভালোবাসিতেন। দশাশ্বমেধঘাটে প্রাতঃস্নান সারিয়া পথে প্রত্যেক শিবলিঙ্গে ফুল ও গঙ্গাজল দিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় এক-এক দিন কোথা হইতে হয়তো একটি সুন্দর খোট্টার ছেলেকে অথবা কোনো ফুটফুটে হিন্দুস্থানী ব্ৰাহ্মণকন্যাকে বাড়িতে আনিয়া উপস্থিত করিতেন। পাড়ার দুটি-একটি সুন্দর ছেলেকে তিনি খেলনা দিয়া, পয়সা দিয়া, খাবার দিয়া বশ করিয়ছিলেন ; তাহারা যখন-তখন তাহার বাড়ির যেখানে-সেখানে উপদ্রব করিয়া খেলিয়া বেড়াইত, ইহাতে তিনি বড়ো আনন্দ পাইতেন। তাহার আর-একটি বাতিক ছিল। ছােটােখাটাে কোনাে একটি সুন্দর জিনিস দেখিলেই তিনি না কিনিয়া থাকিতে পারিতেন না। এ-সমস্ত র্তাহার নিজের