পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আসিত, সেইসঙ্গে কতরকম চুল-বাধাও শিখিয়ছিলাম। সে চলিয়া গেলে আবার আমাকে স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িতে হইত। কী করিব মা, সংস্কার, উহার ভালোমন্দ জানি না।-- না করিয়া থাকিতে পারি না। তোমাদের লইয়াও যে এতটা ছুই-ছুই করি, কিছু মনে করিয়াে না মা। ওটা মনের ঘূণা নয়, ও কেবল একটা অভ্যাস। নলিনদের বাড়িতে যখন অন্যরূপ মত হইল, হিন্দুয়ানি ঘুচিয়া গেল, তখন তো আমি অনেক সহ্য করিয়াছি, কোনো কথাই বলি নাই ; আমি কেবল এই কথাই বলিয়াছি যে, যাহা ভালো বোঝা করো— আমি মুর্থ মেয়েমানুষ, এতকাল যাহা করিয়া আসিলাম তাহা ছাড়িতে পারিব " বলিতে বলিতে ক্ষেমংকরী চোখের এক ফোটা জল তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়া মুছিয়া ফেলিলেন । এমনি করিয়া, হেমনলিনীর খোপা খুলিয়া ফেলিয়া তাহার সুদীর্ঘ কেশগুচ্ছ লইয়া প্রত্যহ নৃত্যুন-নূতন রকম বিনানি করিতে ক্ষেমংকরীর ভারি ভালো লাগিতা। এমনও হইয়াছে, তিনি তাহার সেই আবলুস কাঠের সিন্ধুক হইতে নিজের পছন্দসই রঙের কাপড় বাহির করিয়া তাহাকে পরাইয়া দিয়াছেন। মনের মতো করিয়া সাজাইতে র্তাহার বড়ো আনন্দ । প্রায়ই প্রতিদিন হেমনলিনী তাহার সেলাই আনিয়া ক্ষেমংকরীর কাছে দেখাইয়া লইয়া যাইত ; ক্ষেমংকরী তাহাকে নৃত্যুন-নূতন রকমের সেলাই সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন । এ-সমস্তই তাহার সন্ধ্যার সময়কার কাজ ছিল । বাংলা মাসিকপত্র এবং গল্পের বই পড়িতেও উৎসাহ অল্প ছিল না। হেমনলিনীর কাছে যাহা-কিছু বই এবং কাগজ ছিল, সমস্তই সে ক্ষেমংকরীর কাছে আনিয়া দিয়াছিল । কোনো কোনো প্ৰবন্ধ ও বই সম্বন্ধে ক্ষেমংকরীর আলোচনা শুনিয়া হেম আশ্চর্য হইয়া যাইত ; ইংরাজি না শিখিয়া যে এমন বুদ্ধিবিচারের সহিত চিন্তা করা যায় হেমের তাহা ধারণাই ছিল না । নলিনাক্ষের মাতার কথাবার্তা এবং সংস্কার-আচরণ সমস্ত লইয়া হেমনলিনীর তীহাকে বড়োই আশ্চর্য স্ত্রীলোক বলিয়া বোধ হইল। সে যাহা মনে করিয়া আসিয়াছিল তাহার কিছুই নয়, সমস্তই অপ্রত্যাশিত । 8. ক্ষেমংকরী পুনর্বার জ্বরে পড়িলেন। এবারকার জ্বর অল্পের উপর দিয়া কাটিয়া গেল। সকালবেলায় নলিনাক্ষ প্ৰণাম করিয়া তাহার পায়ের ধূলা লইবার সময় বলিল, “মা, তোমাকে কিছুকাল রোগীর নিয়মে থাকিতে হইবে । দুর্বল শরীরের উপর কঠোরতা সহ্য হয় না।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি রোগীর নিয়মে থাকিব, আর তুমিই যোগীর নিয়মে থাকিবে । নলিন, তোমার ও-সমস্ত আর বেশি দিন চলিবে না । আমি আদেশ করিতেছি, তোমাকে এবার বিবাহ করিতেই হইবে।” নলিনাক্ষ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “দেখো বাছা, আমার এ শরীর আর গড়িবে না ; এখন তোমাকে আমি সংসারী দেখিয়া যাইতে পারিলে মনের সুখে মরিতে পারিব। আগে শিখাইয়া-পড়াইয়া মানুষ করিয়া তুলিব, তাহাকে সাজাইয়া গুজাইয়া মােনর সুখে থাকিব। কিন্তু এবার ব্যামের সময় ভগবান আমাকে চৈতন্য দিয়াছেন । নিজের আয়ুর উপরে এতটা বিশ্বাস রাখা চলে না, আমি কবে আছি কবে নাই তার ঠিকানা কী। একটি ছোটাে মেয়েকে তোমার ঘাড়ের উপর ফেলিয়া গেলে সে আরো বেশি মুশকিল হইবে । তার চেয়ে তোমাদের নিজেদের মতে বড়ো বয়সের মেয়েই বিবাহ করো। জ্বরের সময় এই-সব কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার রাত্রে ঘুম হইত না । আমি বেশ বুঝিয়াছি। এই আমার শেয় কাজ বাকি আছে, এইটি সম্পন্ন করিবার অপেক্ষাতেই আমাকে বাচিতে হইবে, নহিলে আমি শান্তি পাইব না।” r নলিনাক্ষ । আমাদের সঙ্গে মিশ খাইবে, এমন পাত্রী পাইব কোথায় ? ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, সে আমি ঠিক করিয়া তোমাকে বলিব এখন, সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না ।”