পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডবি VORA d আমি তো দূরে থাকিতে চাই, কিন্তু মন্দকে তো খুঁজিয়া বাহির করিতে হয় না ; সে আপনিই ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে। তা, ভালো হােক মন্দ হােক, বলো তোমার কথাটা শুনি।” μ নলিনাক্ষ কহিল, “এই মাঘ মাসে আমি রঙপুরে আমার সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রি করিয়া, আমার বাগানবাড়িটা ভাড়ার বন্দোবস্ত করিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলাম। সঁাড়ায় আসিয়া আমার কী বাতিক গেল, মনে করিলাম, রেলে না চড়িয়া নীেকা করিয়া কলিকাতা পর্যন্ত আসিব । সঁাড়ায় একখানা বড়ো দেশী নীেকা ভাড়া করিয়া যাত্রা করিলাম। দুদিনের পথ আসিয়া একটা চরের কাছে নীেকা বাধিয়া স্নান করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি, আমাদের ভূপেন এক বন্দুক হাতে করিয়া উপস্থিত। আমাকে দেখিয়াই তো সে লাফাইয়া উঠিল, কহিল, “শিকার খুঁজতে আসিয়া খুব বড়ো শিকারটাই মিলিয়াছে।’ সে ঐ দিকেই কোথায় ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট করিতেছিল, তঁবুতে মফস্বল-ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছে। অনেকদিন পরে দেখা, আমাকে তো কোনোমতেই ছাড়িবে না, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরাইয়া বেড়াইতে লাগিল । ধোবাপুকুর বলিয়া একটা জায়গায় একদিন তাহার তাবু পড়িল। বৈকালে আমরা গ্রামে বেড়াইতে বাহির হইয়াছি- নিতান্তই গণ্ডগ্ৰাম, একটি বৃহৎ খেতের ধারে একটা প্রাচীর-দেওয়া চালাঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। ঘরের কর্তা উঠানে আমাদের বসিবার জন্য দুটি মোড়া আনিয়া দিলেন। তখন দাওয়ার উপরে ইস্কুল চলিতেছে। প্রাইমারি ইস্কুলের পণ্ডিত একটা কাঠের চৌকিতে বসিয়া ঘরের একটা খুঁটির গায়ে দুই পা তুলিয়া দিয়াছে। নীচে মাটিতে বসিয়া স্লেট-হাতে ছেলেরা মহা কোলাহল করিতে করিতে বিদ্যালাভ করিতেছে। বাড়ির কর্তাটির নাম তারিণী চাটুজে | ভূপেনের কাছে তিনি তন্ন তন্ন করিয়া আমার পরিচয় লইলেন। তাঁবুতে ফিরিয়া আসিতে আসিতে ভূপেন বলিল, “ওহে, তোমার কপাল ভালো, তোমার একটা বিবাহের সম্বন্ধ আসিতেছে।” আমি বলিলাম, ‘সে কী রকম ? ভূপেন কহিল, “ঐ তারিণী চাটুজে লোকটি মহাজনি করে, এতবড়ো কৃপণ জগতে নাই। ঐ-যে বিশেষ আড়ম্বর করে। কিন্তু ইস্কুলের পণ্ডিতটাকে কেবলমাত্র বাড়িতে খাইতে দিয়া রাত দশটা পর্যন্ত সুদের হিসাব কষাইয়া লয়, মাইনেটা গবর্মেন্টের সাহায্য এবং ইস্কুলের বেতন হইতে উঠিয়া যায়। উহার একটি বোনের স্বামী বিয়োগ হইলে - পর সে বেচারা কোথাও আশ্রয় না পাইয়া ইহারই কাছে আসে । সে তখন গর্ভিণী ছিল । এখানে আসিয়া একটি কন্যা প্রসব করিয়া নিতান্ত অচিকিৎসাতেই সে মারা যায়। আর একটি বিধবা বোন ঘরকন্নার সমস্ত কাজ করিয়া ঝি রাখিবার খরচ বঁাচাইত, সে এই মেয়েটিকে মায়ের মতো মানুষ করে। মেয়েটি কিছু বড়ো হইতেই তাহারও মৃত্যু হইল। সেই অবধি মামা ও মামীর দাসত্ব করিয়া অহরহ ভৎসনা সহিয়া মেয়েটি বাড়িয়া উঠিতেছে। বিবাহের বয়স যথেষ্ট হইয়াছে, কিন্তু এমন অনাথার পাত্র জুটিবে কোথায় ? বিশেষত উহার মা-বােপকে এখানকার কেহ জানিত না, পিতৃহীন অবস্থায় উহার জন্ম ইহা লইয়া পাড়ার ঘোট-কর্তারা যথেষ্ট সংশয়প্রকাশ করিয়া থাকেন। তারিণী চাটুজের অগাধ টাকা আছে সকলেই জানে, লোকের ইচ্ছা— এই মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে কন্যা সম্বন্ধে খোটা দিয়া উহাকে বেশ একটু দোহন করিয়া লয়। ও তো আজ চার বছর ধরিয়া মেয়েটির বয়স দশ বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছে। অতএব, হিসাবমত তার বয়স এখন অন্তত চৌদ্দ হইবে । কিন্তু যাই বল, মেয়েটি নামেও কমলা, সকল বিষয়েই একেবারে লক্ষ্মীর প্রতিমা । এমন সুন্দর মেয়ে আমি তো দেখি নাই। এ গ্রামে বিদেশের কোনো ব্ৰাহ্মণ যুবক উপস্থিত হইলেই তারিণী তাহকে বিবাহের জন্য হাতে-পায়ে ধরে। যদি বা কেহ রাজি হয়, গ্রামের লোকে ভাংচি দিয়া তাড়ায় । অতএব এবারে নিশ্চয় তোমার পালা ।” জান তো মা, আমার মনের অবস্থােটা তখন একরকম মরিয়া গোছের ছিল ; আমি কিছু চিন্তা না করিয়াই বলিলাম, “এ মেয়েটিকে আমিই বিবাহ করিব।” ইহার পূর্বে আমি স্থির করিয়াছিলাম, একটি হিন্দুঘরের মেয়ে বিবাহ করিয়া আনিয়া আমি তোমাকে চমৎকৃত করিয়া দিব ; আমি জানিতাম, বড়ো বয়সের ব্ৰাহ্মমেয়ে আমাদের এ ঘরে আনিলে তাঁহাতে সকল পক্ষই অসুখী হইবে। ভূপেন তো একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। সে বলিল, “কী বল! আমি বলিলাম, “বলাবলি নয়, আমি একেবারেই মন স্থির করিয়াছি।” ভূপেন কহিল, “পাকা ? আমি