পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80 রবীন্দ্র-রচনাবলী বালুতটে অস্পষ্টভাবে ধুধু করিতে লাগিল, হঠাৎ এক জায়গায় কে যেন বিচিত্র রচনাবলীর মাঝখান হইতে সৃষ্টির খানিকটা চিত্ৰলেখা একেবারে মুছিয়া ফেলিয়াছে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত্রি তাহার সমস্ত নির্নিমেষ তারা লইয়া এই জনশূন্য নদীতীরের উপর অতি ধীরে নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল। কমলা সম্মুখে গৃহহীন অনন্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাইল না, কিন্তু সে জানিল, তাহাকে চলিতেই হইবে- কোথাও পৌঁছিবে কি না তাহা ভাবিবার সামর্থ্যও তাহার নাই । বরাবর নদীর ধার দিয়া সে চলিবে, এই সে স্থির করিয়াছে ; তাহা হইলে কাহাকেও পথ জিজ্ঞাসা করিতে হইবে না এবং যদি বিপদ তাহাকে আক্রমণ করে, তবে মুহুর্তের মধ্যেই মা গঙ্গা তাহাকে আশ্রয় দিবেন। আকাশে কুহেলিকার লেশমাত্র ছিল না। অনাবিল অন্ধকার কমলাকে আবৃত করিয়া রাখিল, কিন্তু তাহার দৃষ্টিকে বাধা দিল না । । রাত্ৰি বাড়িতে লাগিল। যবের খেতের প্রান্ত হইতে শৃগাল ডাকিয়া গেল। কমলা বহুদূর চলিতে চলিতে বালুর চর শেষ হইয়া মাটির ডাঙা আরম্ভ হইল। নদীর ধারেই একটা গ্রাম দেখা গেল। কমলা কম্পিত্যুবক্ষে গ্রামের কাছে আসিয়া দেখিল, গ্রামটি সুষুপ্ত। ভয়ে ভয়ে গ্রামটি পার হইয়া চলিতে চলিতে তাহার শরীরে আর শক্তি রহিল না । অবশেষে এক জায়গায় এমন একটা ভাঙাতটের কাছে আসিয়া পৌছিল যেখানে সম্মুখে আর কোনো পথ পাইল না। নিতান্ত অশক্ত হইয়া একটা বটগাছের তলায় শুইয়া পড়িল, শুইবামাত্রই কখন নিদ্ৰা আসিল জানিতেও পারিল না । প্রত্যুষেই চোখ মেলিয়া দেখিল, কৃষ্ণপক্ষের চাদের আলোকে অন্ধকার ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে এবং একটি প্রৌঢ় স্ত্রীলোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, “তুমি কে গা ? শীতের রাত্রে এই গাছের তলায় কে শুইয়া ?” কমলা চকিত হইয়া উঠিয়া বসিল । দেখিল, তাহার অদূরে ঘাটে দুখানা বজরা বাধা রহিয়াছে— এই প্রৌঢ়টি লোক উঠিবার পূর্বেই স্নান সারিয়া লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন । প্রৌঢ়া কহিলেন, “ই গা, তোমাকে যে বাঙালির মতো দেখিতেছি।” কমলা কহিল, “আমি বাঙালি।” প্রৌঢ়া । এখানে পড়িয়া আছ যে ? কমলা । আমি কাশীতে যাইব বলিয়া বাহির হইয়াছি। রাত অনেক হইল, ঘুম আসিল, এইখানেই শুইয়া পড়িলাম । প্রৌঢ়া। ওমা, সে কী কথা ! হাটিয়া কাশী যাইতেছ ? আচ্ছা চলো, ঐ বজরায় চলো, আমি স্নান সারিয়া আসিতেছি । স্নানের পর এই স্ত্রীলোকটির সহিত কমলার পরিচয় হইল । A. গাজিপুরে যে সিদ্ধেশ্বরবাবুদের বাড়িতে খুব ঘটা করিয়া বিবাহ হইতেছিল, তাহারা ইহাদের আত্মীয়। এই প্রৌঢ়টির নাম নবীনকালী । এবং ইহার স্বামীর নাম মুকুন্দলাল দত্ত- কিছুকাল কাশীতেই বাস করিতেছেন । ইহারা আত্মীয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারেন নাই, অথচ পাছে তঁহাদের বাড়িতে থাকিতে বা খাইতে হয় এইজন্য বোটে করিয়া গিয়াছিলেন। বিবাহবাড়ির কত্রী ক্ষোভপ্রকাশ করাতে নবীনকালী বলিয়াছিলেন, “জনই তো ভাই, কর্তার শরীর ভালো নয়। আর ছেলেবেলা হইতে উহাদের অভ্যাসই একরকম। বাড়িতে গোরু রাখিয়া দুধ হইতে মাখন তুলিয়া সেই মাির দিয়ে উত্তর দৃঢ় তৈরি হয়—আবার সে গেরুড়ে যােত খাওয়াইল চলবে না হত্যু নবীনকালী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী ?” কমলা কহিল, “আমার নাম কমলা ।” t নবীনকালী। তোমার হাতে লোহা দেখিতেছি, স্বামী আছে বুঝি ? কমলা কহিল, “বিবাহের পরদিন হইতেই স্বামী নিরুদেশ হইয়া গেছেন।”