পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\OV) রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রথম-প্রথম এ লইয়া তিনি অনেক বকবক করিতেন। তিনি বলিতেন, নাহয় দু-চারখানা চুরি যায় সেও ভালো, আবার গড়াইতে কতক্ষণ । কিন্তু টাকা আছে বলিয়াই যে লোকসান করিতে হইবে সে আমি কোনোমতে সহ্য করিতে পারি না । তার চেয়ে বরঞ্চ কিছুকাল কষ্ট করিয়া থাকাও ভালো। এই দেখো-না, দেশে আমাদের মন্ত বাড়ি, সেখানে লোক-লশকর যতই থাক আসে যায় না, তাই বলিয়া কি এখানে সাত গণ্ডা। চাকর আনা চলে ? কর্তা বলেন, কাছাকাছি নাহয় আরো একটা বাড়ি ভাড়া করা যাইবে । আমি বলিলাম, না, সে আমি পারিব না- কোথায় এখানে একটু আরাম করিব, না কতকগুলো লোকজন-বাড়িঘর লইয়া দিনরাত্রি ভাবনার অন্ত থাকিবে না।” ইত্যাদি । (ł R নবীনকালীর আশ্রয়ে কমলার প্রাণটা যেন অল্পজল। এদো-পুকুরের মাছের মতো ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল। এখােন হইতে বাহির হইতে পারিলে সে বঁাচে, কিন্তু বাহিরে গিয়া দাড়াইবে কোথায় ? সেদিনকার রাত্রে গৃহহীন বাহিরের পৃথিবীকে সে জানিয়াছে ; সেখানে অন্ধভাবে আত্মসমর্পণ করিতে আর তাহার সাহস হয় না | নবীনকালী যে কমলাকে ভালোবাসিতেন না। তাহা নহে, কিন্তু সে ভালোবাসার মধ্যে রস ছিল না । দুই-এক দিন অসুখ-বিসুখের সময় তিনি কমলাকে যত্নও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে যত্ন কৃতজ্ঞতার সহিত গ্ৰহণ করা বড়ো কঠিন । বরঞ্চ সে কাজকর্মের মধ্যে থাকিত ভালো, কিন্তু যে-সময়টা নবীনকালীর সখীত্বে তাহাকে যাপন করিতে হইত। সেইটেই তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসময় । একদিন সকালবেলা নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া কহিলেন, “ওগো, ও বামুনঠাকরুন, আজ কর্তার শরীর বড়ো ভালো নাই, আজ ভাত হইবে না, আজ রুটি । কিন্তু তাই বলিয়া একরাশ ঘি লাইয়ো না । জানি তো তোমার রান্নার শ্ৰী, উহাতে এত ঘি কেমন করিয়া খরচ হইবে তাহা তো বুঝিতে পারি না। এর চেয়ে সেই যে উড়ে বামুনটা ছিল ভালো, সে ঘি লইত বটে, কিন্তু রান্নায় ঘিয়ের স্বাদ একটু-আধটু পাওয়া যাইত ।” কমলা এ-সমস্ত কথার কোনো জবাবই করিত না ; যেন শুনিতে পায় নাই, এমনিভাবে নিঃশব্দে সে কাজ করিয়া যাইত । আজ অপমানের গোপনভারে আক্রান্তহৃদয় হইয়া কমলা চুপ করিয়া তরকারি কুটিতেছিল, সমস্ত পৃথিবী বিরস এবং জীবনটা দুঃসহ বোধ হইতেছিল, এমন সময় গৃহিণীর ঘর হইতে একটা কথা তাহার কানে আসিয়া কমলাকে একেবারে চকিত করিয়া তুলিল। নবীনকালী তাহার চাকরকে ডাকিয়া বলিতেছিলেন, “ওরে তুলসী, যা তো, শহর হইতে নলিনাক্ষ ডাক্তারকে শীঘ্ৰ ডাকিয়া আন । বল, কর্তার শরীর বড়ো খারাপ ।” নলিনাক্ষ ডাক্তার !! কমলার চোখের উপরে সমস্ত আকাশের আলো আহত বীণার স্বৰ্ণতন্ত্রীর মতো কঁাপিতে লাগিল। সে তরকারি-কেটা ফেলিয়া দ্বারের কাছে আসিয়া দাড়াইল । তুলসী নীচে নামিয়া আসিতেই কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইতেছিস তুলসী ?” সে কহিল, “নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিতে যাইতেছি।” কমলা কহিল, “সে আবার কোন ডাক্তার ?” তুলসী কহিল, “তিনি এখানকার একটি বড়ো ডাক্তার বটে।” কমলা । তিনি থাকেন কোথায় ? তুলসী কহিল, “শহরেই থাকেন, এখান হইতে আধ ক্রোশটাক হইবে।” আহারের সামগ্ৰী অল্পস্বল্প যাহা-কিছু বঁাচাইতে পারিত, কমলা তাহাই বাড়ির চাকর-বকিরদের ভাগ করিয়া দিত। এজন্য সে ভৎসনা অনেক সহিয়াছে, কিন্তু এ অভ্যাস ছাড়িতে পারে নাই। বিশেষত গৃহিণীর কড়া আইন অনুসারে এ বাড়ির লোকজনদের খাবার কষ্ট অত্যন্ত বেশি। তা ছাড়া কর্তা-গৃহিণীর খাইতে বেলা হইত ; ভূত্যেরা তাহার পরে খাইতে পাইত। তাহারা যখন আসিয়া