পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOCby রবীন্দ্র-রচনাবলী অক্ষয় কহিল, “কিন্তু আশ্চর্য এই যে, স্ত্রী যত ভালো হয় তাহার অনাদরও তত বেশি হইয়া থাকে । ভগবান ভালো লোকদিগকেই বোধ করি সব চেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন।” এই বলিয়া অক্ষয় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । অন্নদা তাহার বিরল কেশরাশির মধ্যে অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে বলিলেন, “বড়ো দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই, কিন্তু যাহা হইবার তা তো হইয়াই গেছে, এখন আর বৃথা শোক করিয়া ফল কী ?” অক্ষয় কহিল, “আমার মনে সন্দেহ হইল, যদি এমন হয়, কমলা আত্মহত্যা না করিয়া ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়া থাকেন । তাই চক্রবর্তমহাশয়কে লইয়া কাশীতে একবার সন্ধান করিতে আসিলাম । বেশ বুঝা যাইতেছে, আপনারা কোনো খবরই পান নাই। যাহা হউক, দু-চারদিন এখানে তল্লাশ করিয়া দেখা যাক ৷” অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ এখন কোথায় আছেন ?” খুড়া কহিলেন, “তিনি তো আমাদিগকে কিছু না বলিয়াই চলিয়া গেছেন।” অক্ষয় কহিল, “আমার সঙ্গে দেখা হয় নাই, কিন্তু লোকের মুখে শুনিলাম, তিনি কলিকাতাতেই গেছেন। বোধ করি আলিপুরে প্র্যাকটিস করিবেন । মানুষ তো আর অনন্তকাল শোক করিয়া কাটাইতে পারে না, বিশেষত র্তাহার অল্প বয়স । চক্রবর্তমহাশয়, চলুন, শহরে একবার ভালো করিয়া খোজ করিয়া দেখা যাক ৷” অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “অক্ষয়, তুমি তো এইখানেই আসিতেছ?” অক্ষয় কহিল, “ঠিক বলিতে পারি না। আমার মনটা বড়োই খারাপ হইয়া আছে। অন্নদাবাবু। যত দিন কাশীতে আছি, আমাকে এই খোজেই থাকিতে হইবে । বলেন কী, ভদ্রলোকের মেয়ে, যদিই তিনি মনের দুঃখে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়া থাকেন, তবে আজ কী বিপদেই পড়িয়াছেন বলুন দেখি । রমেশবাবু দিব্য নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারেন, কিন্তু আমি তো পারি না।” খুড়াকে সঙ্গে লইয়া অক্ষয় চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু অত্যন্ত উদবিগ্ন হইয়া একবার হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। হেমনলিনী প্ৰাণপণে নিজেকে সংযত করিয়া বসিয়াছিল । সে জানিত, তাহার পিতা মনে মনে তাহার জন্য আশঙ্কা অনুভব করিতেছেন। হেমনলিনী কহিল, “বাবা, আজ একবার ডাক্তারকে দিয়া তোমার শরীরটা ভালো করিয়া পরীক্ষা করাও । একটুকুতেই তোমার স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যায়, ইহার একটা প্রতিকার করা উচিত।” অন্নদাবাবু মনে মনে অত্যন্ত আরাম অনুভব করিলেন। রমেশকে লইয়া এতবড়ো আলোচনাটার পর হেমনলিনী যে র্তাহার পীড়া লইয়া উদবেগ প্রকাশ করিল, ইহাতে র্তাহার মনের মধ্য হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। অন্য সময় হইলে তিনি নিজের পীড়ার প্রসঙ্গ উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করিতেন ; আজ কহিলেন, “সে তো বেশ কথা । শরীরটা নাহয় পরীক্ষা করানোই যাক। তাহা হইলে আজ নাহয় একবার নলিনাক্ষকে ডাকিতে পাঠাই। কী বল ?” নলিনাক্ষ সম্বন্ধে হেমনলিনী একটুখানি সংকোচে পড়িয়া গেছে। পিতার সম্মুখে তাহার সহিত পূর্বের ন্যায় সহজভাবে মেলা তাহার পক্ষে কঠিন হইবে, তবু সে বলিল, “সেই ভালো, তাহাকে ডাকিতে লোক পঠাইয়া দিই।” অন্নদাবাবু হেমের অবিচলিত ভাব দেখিয়া ক্রমে সাহস পাইয়া কহিলেন, “হেম, রমেশের এই সমস্ত ”ــــــــــوچ۹ হেমনলিনী তৎক্ষণাৎ তাহাকে বাধা দিয়া কহিল, “বাবা, রৌদ্রের ঝাজ বাড়িয়া উঠিয়াছে- চলো, এখন ঘরে চলো ।” বলিয়া তাহাকে আপত্তি করিবার অবসর না দিয়া হাত ধরিয়া ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। সেখানে তঁহাকে আরাম-কেদারায় বসাইয়া তাহার গায়ে বেশ করিয়া গরম কাপড় জড়াইয়া দিয়া তাহার হাতে একখানি খবরের কাগজ দিল এবং চশমার খাপ হইতে চশমাটি বাহির করিয়া নিজে তাহার চোখে পরাইয়া দিয়া কহিল, “কাগজ পড়ো, আমি আসিতেছি।”