পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\98 N রবীন্দ্র-রচনাবলী নবীনকালী তাহাকে কয়দিন সর্বদাই কাছে কাছে রাখিয়াছেন, তাহাকে দিয়াই জিনিসপত্র বঁাধাৰ্ছাদার অনেক কাজ করাইয়া লইয়াছেন । কমলা একান্তমনে কামনা করিতে লাগিল, আজ রাত্রির মধ্যে তাহার এমন একটা কঠিন পীড়া হয় যে, তাহাকে সঙ্গে লইয়া যাওয়া নবীনকালীর পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠে। সেই গুরুতর পীড়ার চিকিৎসাভার কোন ডাক্তারের উপর পাড়িবে তাহাও সে মনে মনে ভাবে নাই এমন নহে। এই পীড়ায় যদি অবশেষে তাহার মৃত্যু ঘটে, তবে আসন্ন মৃত্যুকালে সেই চিকিৎসকের পায়ের ধূলা লইয়া সে মরিতে পরিবে, ইহাও সে চােখ বুজিয়া কল্পনা করিতেছিল। রাত্রে নবীনকালী কমলাকে আপনার ঘরে লইয়া শুইলেন । পরদিন স্টেশনে যাইবার সময় নিজের গাড়ির মধ্যে তুলিয়া লইলেন। কর্তা মুকুন্দবাবু রেলগাড়িতে সেকেন্ড ক্লাসে উঠলেন, নবীনকালী অবশেষে গাড়ি কাশী স্টেশন ছাড়িল ; মত্ত হন্তী যেমন করিয়া লতা ছিড়িয়া লয়, তেমনি করিয়া রেলগাড়ি গর্জন করিতে করিতে কমলাকে ছিড়িয়া লইয়া চলিয়া গেল। কমলা ক্ষুধিতচক্ষে জানলা গুপ্তািন্স দিকে চাহিয়া বহিল। নবীনকালী কহিলেন বাক্ষসকরুণ পালে ডিপেটা কােৱা কমলা পানের ডিপেটা বাহির করিয়া দিল। ডিপে খুলিয়া নবীনকালী কহিলেন, “এই দেখো, যা ভাবিয়ছিলাম, তাই হইয়াছে। চুনের কীেটােটা ফেলিয়া আসিয়াছ ? এখন আমি করি কী। যেটি আমি নিজে না দেখিব সেটিতে একটা-না-একটা গলদ হইয়া আছেই। এ কিন্তু বামুন-ঠাকরুন, তুমি শয়তানি আজ তরকারিতে নুন নাই, কাল পায়েসে ধরা গন্ধ— মনে করিতেছ, এ-সমস্ত চালাকি আমরা বুঝি না। আচ্ছা, চলো মিরাটে, তার পরে দেখা যাইবে তুমিই বা কে আর আমিই বা কে ৷” গাড়ি যখন পুলের উপর দিয়া চলিল, কমলা জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া গঙ্গাতীরবর্তী কাশী শহরটা একবার দেখিয়া লইল । ঐ শহরের মধ্যে কোন দিকে যে নলিনাক্ষের বাড়ি তাহা সে কিছুই জানে না। এইজন্য রেলগাড়ির দ্রুতধাবনের মধ্যে ঘাট, বাড়ি, মন্দির চুড়া যাহা-কিছু তাহার চক্ষে পড়িল, সমস্তই নলিনাক্ষের আবির্ভাবের দ্বারা মণ্ডিত হইয়া তাহার হৃদয়কে স্পর্শ করিল। নবীনকালী কহিলেন, “ওগো, অত করিয়া কুঁকিয়া দেখিতেছি কী ? তুমি তো পাখি নও, তোমার ডানা নাই যে উড়িয়া যাইবে।” কাশী নগরীর চিত্র কোথায় আচ্ছন্ন হইয়া গেল। কমলা স্থিরনীরব হইয়া বসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল । অবশেষে গাড়ি মোগলসরাইয়ে থামিল । কমলার কাছে স্টেশনের গোলমাল, লোকজনের ভিড়, সমস্তই ছায়ার মতো, স্বপ্নের মতো বোধ হইতে লাগিল। সে কলের পুতলির মতো এক গাড়ি হইতে অন্য গাড়িতে উঠিল । গাড়ি ছাড়িবার সময় হইয়া আসিতেছে, এমন সময় কমলা হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া শুনিতে পাইল তাহাকে কে পরিচিত কণ্ঠে “মা” বলিয়া ডাকিয়া উঠিয়াছে। কমলা প্ল্যাটফর্মের দিকে মুখ ফিরাইয় দেখিল— উমেশ । কমলার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল ; “কহিল, কী রে উমেশ !” উমেশ গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল এবং মুহুর্তের মধ্যে কমলা নামিয়া পড়িল। উমেশ তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিয়া কমলার পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল । তাহার সমস্ত মুখ আকৰ্ণপ্রসারিত হাসিতে ভরিয়া গেল । পরীক্ষণেই গার্ড কামরার দরজা বন্ধ করিয়া দিল । নবীনকালী চোঁচামেচি করিতে লাগিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, করিতেছ। কী ! গাড়ি ছাড়িয়া দেয় যে ! ওঠে, ওঠে !” কমলার কানে সে কথা পৌঁছিলই না। গাড়িও বাঁশি ফুকিয়া দিয়া গসগস শব্দে স্টেশন হইতে