পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏔᏬᏩᏚᎸ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিবে না। তখন ওর কী দশা হইবে ভাবিয়া দেখো দেখি । একেবারে ভাসিয়া বেড়াইবে । যাই হােক, বলো তো বাছা, তুমি তো নলিনকে শ্রদ্ধা কর আমি জানি, তবে তোমার মনে আপত্তি উঠিতেছে কেন ?” । হেমনলিনী নতনেত্ৰে কহিল, “মা, তুমি যদি আমাকে যোগ্য মনে কর। তবে আমার কোনো আপত্তি नाई ।” শুনিয়া ক্ষেমংকরী হেমনলিনীকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার মাথায় চুম্বন করিলেন। এ সম্বন্ধে আর কোনো কথা বলিলেন না । “হরিদাসী, এ ফুলগুলো—” বলিতে বলিতে পাশে চাহিয়া দেখিলেন, হরিদাসী নাই। সে নিঃশব্দপদে কখন উঠিয়া গেছে। পূর্বোক্ত আলোচনার পর ক্ষেমংকরীর কাছে হেমনলিনী সংকোচ বােধ করিল, ক্ষেমংকরীরও বাধো-বাধো করিতে লাগিল । তখন হেম কহিল, “মা, আজ তবে সকাল-সকাল যাই । বাবার শরীর ভালো নাই।” বলিয়া ক্ষেমংকরীকে প্ৰণাম করিল। ক্ষেমংকরী তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “এসো মা, a " হেমনলিনী চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া পাঠাইলেন ; কহিলেন, “নলিন, আর আমি দেরি করিতে পারিব না ।” নলিনাক্ষ কহিল, “ব্যাপারখানা কী ?” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি আজ হেমকে সব কথা খুলিয়া বলিলাম ; সে তো রাজি হইয়াছে, এখন তোমার কোনো ওজর আমি শুনিতে চাই না । আমার শরীর তো দেখিতেছিস । তোদের একটা স্থিতি না করিয়া আমি কোনোমতেই সুস্থির হইতে পারিতেছি না। অর্ধেক রাত্রে ঘুম ভাঙিয়া আমি ঐ কথাই ভাবি ।” নলিনাক্ষ কহিল, “আচ্ছা মা, ভাবিয়ে না, তুমি ভালো করিয়া ঘুমাইয়ো, তুমি যেমন ইচ্ছা কর তাহাই হইবে।” নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, “হরিদাসী !” কমলা পাশের ঘর হইতে চলিয়া আসিল । তখন অপরাহ্রের আলোক স্নান হইয়া ঘর প্রায় অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। হরিদাসীর মুখ ভালো করিয়া দেখা গেল না। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বাছা, এই ফুলগুলিতে জল দিয়া ঘরে সাজাইয়া রাখো৷ ” বলিয়া বাছিয়া একটি গোলাপ তুলিয়া ফুলের সাজিটি কমলার দিকে অগ্রসর করিয়া দিলেন । কমলা তাহার মধ্যে কতকগুলি ফুল তুলিয়া একটি থালায় সাজাইয়া নলিনাক্ষের উপাসনাগৃহের আসনের সম্মুখে রাখিল। আর-কতকগুলি একটি বাটিতে করিয়া নলিনাক্ষের শোবার ঘরে টিপাইয়ের উপর রাখিয়া দিল। বাকি কয়েকটি ফুল লইয়া সেই দেয়ালের গায়ের আলমারিটা খুলিয়া এবং সেই খড়ম-জোড়ার উপর ফুলগুলি রাখিয়া তাহার উপরে মাথা ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিতেই তাহার চোখ দিয়া আজ ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। এই খড়ম ছাড়া জগতে তাহার আর-কিছুই নাই— পদসেবার অধিকারও হারাইতে বসিয়াছে। এমন সময়ে হঠাৎ ঘরে কে প্রবেশ করিতেই কমলা ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি আলমারির দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া দেখিল, নলিনাক্ষ । কোনো দিকে কমলা পালাইবার পথ পাইল না- লজ্জায় কমলা সেই আসন্ন সায়াহের অন্ধকারে মিশাইয়া গেল না কেন । নলিনাক্ষ ঘরের মধ্যে কমলাকে দেখিয়া বাহির হইয়া গেল। কমলাও আর বিলম্ব না করিয়া দ্রুতপদে অন্য ঘরে চলিয়া গেল। তখন নলিনাক্ষ পুনর্বার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মেয়েটি আলমারি খুলিয়া কী করিতেছিল, তাহাকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি বন্ধ করিলই বা কেন ? কৌতুহলবশত নলিনাক্ষ আলমারি খুলিয়া দেখিল, তাহার খড়ম-জোড়ার উপর কতকগুলি সদ্যসিক্ত ফুল রহিয়াছে।