পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডবি ስ ኑ VVS () ক্ষেমংকরীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী তাঁহাদের বসিবার ঘরের টেবিলের উপর একখানা মস্ত ভারী চিঠি পাইল। লেফাফার উপরকার হস্তাক্ষর দেখিয়াই বুঝিতে পারিল, চিঠিখানা বুমেশের লেখা। স্পন্দিতবক্ষে চিঠিখানি হাতে করিয়া শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িতে লাগিল । চিঠিতে রমেশ কমলা-সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপাের আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছে। উপসংহারে লিখিয়াছে তোমার সহিত আমার যে বন্ধন ঈশ্বর দৃঢ় করিয়া দিয়াছিলেন সংসার তাহা ছিন্ন করিয়াছে। তুমি এখন অন্যের প্রতি চিত্ত সমর্পণ করিয়াছ- সেজন্য আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারি না, কিন্তু তুমিও আমাকে দোষ দিয়ে না। যদিও আমি একদিনের জন্যও কমলার প্রতি স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি নাই। তথাপি ক্রমশ সে যে আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল, এ কথা তোমার কাছে আমার স্বীকার করা কর্তব্য । আজ আমার হৃদয় কী অবস্থায় আছে তাহা আমি নিশ্চয় জানি না। তুমি যদি আমাকে ত্যাগ না করিতে। তবে তোমার মধ্যে আমি আশ্রয় লাভ করিতে পারিতাম। সেই আশ্বাসেই আমি আমার বিক্ষিপ্ত চিত্ত লইয়া তোমার নিকট ছুটিয়া আসিয়ছিলাম। কিন্তু আজ যখন স্পষ্ট দেখিলাম তুমি আমাকে ঘূণা করিয়া আমার নিকট হইতে বিমুখ হইয়াছ, যখন শুনিলাম অন্যের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধে তুমি সম্মতি দিয়াছ, তখন আমারও মন আবার দােলায়িত হইয়া উঠিল। দেখিলাম এখনাে কমলাকে সম্পূর্ণ ভুলিতে পারি নাই। ভুলি বা না ভুলি, তাহাতে সংসারে আমি ছাড়া আর-কাহারও কোনো ক্ষতি নাই। আমারই বা ক্ষতি কিসের ! সংসারে যে দুটি রমণীকে আমি হৃদয়ের মধ্যে গ্ৰহণ করিতে পরিয়াছি তাহাদিগকে বিস্মৃত হইবার সাধ্য আমার নাই এবং তঁহাদিগকে চিরজীবন স্মরণ করাই আমার পরম লাভ । আজ প্রাতে যখন তোমার সহিত ক্ষণিক সাক্ষাতের বিদ্যুদিবৎ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম তখন একবার মনে মনে বলিলাম, “আমি হতভাগ্য !” কিন্তু আর আমি সে কথা স্বীকার করিব না । আমি সবলচিত্তে আনন্দের সহিত তোমার নিকট বিদায় প্রার্থনা করিতেছি— আমি পরিপূর্ণ হৃদয়ে তোমার নিকট হইতে প্রস্থান করিব— তোমাদের কল্যাণে, বিধাতার কল্যাণে, আমি অস্তরের মধ্যে এই বিদায়কালে যেন কিছুমাত্র দীনতা অনুভব না করি। তুমি সুখী হও, তোমার মঙ্গল হউক। আমাকে তুমি ঘূণা করিয়াে না, আমাকে ঘূণা করিবার কোনো কারণ তোমার নাই । অন্নদাবাবু চৌকিতে বসিয়া বই পড়িতেছিলেন। হঠাৎ হেমনলিনীকে দেখিয়া তিনি চমকিয়া উঠিলেন ; কহিলেন, “হেম, তোমার কি অসুখ করিয়াছে ?” হেমনলিনী কহিল, “অসুখ করে নাই। বাবা, রমেশবাবুর একখানি চিঠি পাইয়াছি। এই লও, পড়া হইলে আবার আমাকে ফেরত দিয়ে ।” এই বলিয়া চিঠি দিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু চশমা লইয়া চিঠিখনি বার-দুয়েক পড়িলেন, তাহার পরে হেমনলিনীর নিকট ফেরত পঠাইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। অবশেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, এ একপ্রকার ভালেই হইয়াছে। পাত্র হিসাবে রমেশের চেয়ে নলিনাক্ষ অনেক বেশি প্রার্থনীয়। ক্ষেত্ৰ হইতে রমেশ যে আপনিই সরিয়া পড়িল, এ হইল ভালো । এ কথা ভাবিতেছেন, এমন সময় নলিনাক্ষ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া অন্নদাবাবু একটু আশ্চর্য হইলেন। আজ পূর্বাস্তুে নলিনাক্ষের সঙ্গে অনেকক্ষণ দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছে, আবার কয়েক ঘণ্টা যাইতে না যাইতেই সে কী মনে করিয়া আসিল ? বৃদ্ধ মনে মনে একটুখানি হাসিয়া স্থির করিলেন, হেমনলিনীর প্রতি নলিনক্ষের মন পড়িয়ছে। কোনো ছুতা করিয়া হেমনলিনীর সহিত নলিনাক্ষের দেখা করাইয়া দিয়া নিজে সিরিয়া যাইবেন *গনা করিতেছেন, এমন সময় নলিনাক্ষ কহিল, “অন্নদাবাবু, আমার সঙ্গে আপনার কন্যার বিবাহের