পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি we)\ኃዔ দিবেন- আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন, আপনাদের কাছে জ্ঞানপূর্বক এ একদিনের জন্যও অপরাধিনী হইবে না ।” কমলা লজ্জায় মুখখানি রাঙা করিয়া নতশিরে বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “চক্রবর্তমশায়, আপনি কিছুই ভাবিবেন না, হরিদাসী আমাদের ঘরের মেয়েই হইল । ওকে আমাদের কোনো কাজ দিবার জন্য আমাদের তরফ হইতে আজ পর্যন্ত কোনো চেষ্টা করিবার দরকারই হয় নাই। এ বাড়ির রান্নাঘরে ভাড়ার-ঘরে এতদিন আমার শাসনই একমাত্র প্রবল ছিল, এখন আমি সেখানে কেহই না । চাকর-বাকররাও আমাকে আর বাড়ির গৃহিণী বলিয়া গণ্যই করে না। কেমন করিয়া যে আস্তে আস্তে আমার এমন অবস্থাটা হইল, তাহা আমি টেরও পাইলাম না। আমার গোটাকিয়েক চাবি ছিল, সেও কৌশল করিয়া হরিদাসী আত্মসাৎ করিয়াছে— চক্রবর্তমশায়, আপনার এই ডাকাত মেয়েটির জন্যে আপনি আর কী চান বলুন দেখি ! এখন সব চেয়ে বড়ো ডাকাতি হয় যদি আপনি বলেন, এই মেয়েটিকে আমরা লইয়া যাইব ।” চক্রবর্তী কহিলেন, “আমি যেন বলিলাম, কিন্তু মেয়েটি কি নড়িবে ? তা মনেও করিবেন না । উহাকে আপনারা এমন ভুলইয়াছেন যে, আজ। আপনারা ছাড়া ও আর পৃথিবীতে কাহাকেও জানে না। দুঃখের জীবনে এতদিন পরে ও আপনাদের কাছেই আজ শান্তি পাইয়াছে- ভগবান ওর সেই শান্তি নির্বিঘ্ন করুন, আপনারা চিরদিন ওর পরে প্রসন্ন থাকুন, উহাকে সেই আশীর্বাদ করি।” বলিতে বলিতে চক্রবর্তীর চক্ষু সজল হইয়া আসিল । নলিনাক্ষ কিছু না বলিয়া স্তব্ধ হইয়া চক্রবতীর কথা শুনিতেছিল ; যখন সকলে বিদায় লইয়া গেলেন তখন ধীরে ধীরে সে আপনার ঘরে গিয়া প্ৰবেশ করিল। তখন শীতের সূর্যস্তকাল তাহার সমস্ত শয়নঘরটিকে নববিবাহের রক্তিমােচ্ছটায় রঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছিল। সেই রক্তবর্ণের আভা নলিনাক্ষের সমস্ত রোমকৃপ ভেদ করিয়া তাহার অন্তঃকরণকে যেন রাঙাইয়৷ তুলিল । আজ সকালে নলিনাক্ষের এক হিন্দুস্থানি বন্ধুর কােছ হইতে এক টুকরি গোলাপ আসিয়াছিল। ঘর সাজাইবার জন্য সেই গোলাপের টুকরি ক্ষেমংকরী কমলার হাতে দিয়াছিলেন । নলিনাক্ষের শয়নঘরের প্রান্তে একটি ফুলদানি হইতে সেই গোলাপের গন্ধ তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। সেই নিস্তব্ধ ঘরের বাতায়নের আরক্ত সন্ধ্যার সঙ্গে গোলাপের গন্ধ মিশিয়া নলিনাক্ষের মনকে কেমন যেন উতলা করিয়া তুলিল। এতদিন তাহার বিশ্বে চারি দিকে সংযমের শান্তি, জ্ঞানের গভীরতা ছিল, আজ সেখানে হঠাৎ এমন নানা সুরের নহবত বাজিয়া উঠিল কোথা হইতে— কোন অদৃশ্য নৃত্যের চরণক্ষেপে ও নূপুরঝংকারে আজ আকাশতল এমন চঞ্চল হইয়া উঠিতে লাগিল ! নলিনাক্ষ জানলা হইতে ফিরিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া দেখিল, তাহার বিছানার শিয়রের কাছে কুলুঙ্গির উপরে গোলাপফুলগুলি সাজানো রহিয়াছে। এই ফুলগুলি জানি না কাহার চােখের মতো শুরুর মুখের দিকে চাহিয়া বলি, নিশব্দ আত্মনিবেদনের মতো তাহার কাফের দ্বারপ্রছে নত ইয়া তুলে । নলিনাক্ষ ইহার মধ্যে একটি ফুল তুলিয়া লইল— সেটি কাচা সোনার রঙের হলদে গোলাপ, পাপড়িগুলি খোলে নাই, কিন্তু গন্ধ লুকাইতে পারিতেছে না। সেই গোলাপটি হাতে লইতেই যেন সে কাহার আঙুলের মতো তাহার আঙুলিকে স্পর্শ করিল, তাহার শরীরের সমস্ত স্নায়ুতন্তুকে রিমিঝিমি করিয়া বাজাইয়া তুলিল। নলিনাক্ষ সেই স্নিগ্ধকোমল ফুলটিকে নিজের মুখের উপরে, চােখের পল্লবের উপরে বুলাইতে লাগিল ! . দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যাকাশ হইতে অস্তসূর্যের আভা মিলাইয়া আসিল । নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইবার পূর্বে একবার তাহার বিছানার কাছে গিয়া শয্যার আচ্ছাদনটি তুলিয়া ফেলিল এবং মাথার বালিশের উপর সেই গোলাপফুলটি রাখিল । রাখিয়া উঠিয়া আসিবে, এমন সময় খাটের ও পাশে মেঝের উপরে ও কে অঞ্চলে মুখ ঝাপিয়া লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশাইতে চাহিল! হায় রে কমলা, লজ্জা রাখিবার আর স্থান নাই। সে আজ কুলুঙ্গিতে গোলাপ সাজাইয়া স্বহস্তে নলিনাক্ষের