পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা w9brዒ গোরা কহিল, “তই বৈকি ! এর পরে বৃষ্টিবাদল যখন ধরে যাবে তখন বিনয় বলবেন, যে রোদ পড়েছে! দেবতার উপর দোষ দিলে দেবতা তো কোনো জবাব করেন না— আসল মনের কথা অন্তর্যামীই জানেন ।” বিনয় কহিল, “গোরা, তুমি কী বাজে ব্যকছ!” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা সত্যি বাছা, অমন করে বলতে নেই। মানুষের মন কখনো ভালো থাকে কখনো মন্দ থাকে, সব সময় কি সমান যায় ! তা নিয়ে কথা পাড়তে গেলে উৎপাত করা হয় । তা আয় বিনু, আমার ঘরে আয়, তোর জন্যে খাবার ঠিক করেছি।” গোরা জোর করিয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, “না মা, সে হচ্ছে না, তোমার ঘরে আমি বিনয়কে খেতে দেব না ।” আনন্দময়ী। ইস, তাই তো ! কেন বাপু, তোকে তো আমি কোনোদিন খেতে বলি নে- এ দিকে তোর বাপ তো ভয়ংকর শুদ্ধাচারী হয়ে উঠেছেন— স্বপাক না হলে খান না। বিনু আমার লক্ষ্মী ছেলে, তোর মতো। ওর গোড়ামি নেই, তুই কেবল ওকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখতে চাস । গোরা। সে কথা ঠিক, আমি জোর করেই ওকে ঠেকিয়ে রাখব। তোমার ঐ খৃস্টান দাসী লছমিয়াটাকে না বিদায় করে দিলে তোমার ঘরে খাওয়া চলবে না । আনন্দময়ী। ওরে গোরা, অমন কথা তুই মুখে আনিস নে। চিরদিন ওর হাতে তুই খেয়েছিস-ও তোকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছে। এই সেদিন পর্যন্ত ওর হাতের তৈরি চাটনি না হলে তোর যে খাওয়া রুচিত না । ছোটোবেলায় তোর যখন বসন্ত হয়েছিল। লছমিয়া যে করে তোকে সেবা করে বঁচিয়েছে সে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। গোরা। ওকে পেনসন দাও, জমি কিনে দাও, ঘর কিনে দাও, যা খুশি করো, কিন্তু ওকে রাখা চলবে না। মা | আনন্দময়ী। গোরা, তুই মনে করিস টাকা দিলেই সব ঋণ শোধ হয়ে যায়! ও জমিও চায় না, বাড়িও চায় না, তোকে না দেখতে পেলে ও মরে যাবে। গোরা। তবে তোমার খুশি ওকে রাখে। কিন্তু বিনু তোমার ঘরে খেতে পাবে না। যা নিয়ম তা মনতেই হবে, কিছুতেই তার অন্যথা হতে পারে না। মা, তুমি এতবড়ো অধ্যাপকের বংশের মেয়ে, তুমি যে আচার পালন করে চল না। এ কিন্তু আনন্দময়ী | ওগো, তোমার মা আগে আচার পালন করেই চলত ; তাই নিয়ে অনেক চোখের জল ফেলতে হয়েছে- তখন তুমি ছিলে কোথায় ? রোজ শিব গড়ে পুজো করতে বসতুম আর তোমার বাবা এসে টান মেরে ফেলে ফেলে দিতেন। তখন অপরিচিত বামুনের হাতেও ভাত খেতে আমার ঘেন্না করত। সেকালে রেলগাড়ি বেশিদূর ছিল না- গোরুর গাড়িতে, ডাকগাড়িতে, পালকিতে, উটের উপর চড়ে কতদিন ধরে কত উপোস করে কাটিয়েছি। তোমার বাবা কি সহজে আমার আচার ভাঙতে পেরেছিলেন ? তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন বলে তার সায়েব-মনিবরা তাকে বাহবা দিত, তার মাইনেই বেড়ে গেল- ঐজন্যেই তাকে এক জায়গায় অনেক দিন রেখে দিত- প্ৰায় নড়াতে চাইত না। এখন তো বুড়োবয়সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাশ রাশ টাকা নিয়ে তিনি হঠাৎ উলটে খুব শুচি হয়ে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু আমি তা পারব না। আমার সাত পুরুষের সংস্কার একটা একটা করে নিমূল করা হয়েছে- সে কি এখন আর বললেই ফেরে ? গোরা। আচ্ছা, তোমার পূর্বপুরুষদের কথা ছেড়ে দাও- তারা তো কোনো আপত্তি করতে আসছেন না। কিন্তু আমাদের খাতিরে তোমাকে কতকগুলো জিনিস মেনে চলতেই হবে। নাহয় শাস্ত্রের মান নাই রাখলে, স্নেহের মান রাখতে হবে তো । আনন্দময়ী। ওরে, অত করে আমাকে কী বোঝাচ্ছিস । আমার মনে কী হয় সে আমিই জানি । আমার স্বামী, আমার ছেলে, আমাকে নিয়ে তাদের যদি পদে পদে কেবল বাধতে লাগল। তবে আমার আর সুখ কী নিয়ে। কিন্তু তোকে কোলে নিয়েই আমি আচার ভাসিয়ে দিয়েছি তা জানিস ? ছোটাে