পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা \OSY উঠিয়াছে। গোরা সেই সময় আলোটি জ্বালাইয়া লিখিতে বসিয়াছে। গোরা কাগজ হইতে মুখ না তুলিয়াই কহিল, “কি গো বিনয়, হাওয়া কোন দিক থেকে বইছে ?” বিনয় সে কথায় কৰ্ণপাত না করিয়া কহিল, “গোরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি । ভারতবর্ষ তোমার কাছে খুব সত্য ? খুব স্পষ্ট ? তুমি তো দিনরাত্রি তাকে মনে রােখ, কিন্তু কিরকম করে। মনে রাখা ?” গোরা লেখা ছাড়িয়া কিছুক্ষণ তাহার তীক্ষ দৃষ্টি লইয়া বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল ; তাহার পরে কলামটা রাখিয়া চৌকির পিঠের দিকে ঠেস দিয়া কহিল, “জাহাজের কাপ্তেন যখন সমুদ্রে পাড়ি দেয় তখন যেমন আহারে বিহারে কাজে বিশ্রামে সমুদ্রপারের বন্দরটিকে সে মনের মধ্যে রেখে দেয় আমার ভারতবর্ষকে আমি তেমনি করে মনে রেখেছি।” বিনয় । কোথায় তোমার সেই ভারতবর্ষ ? গোরা বুকে হাত দিয়া কহিল, “আমার এইখানকার কম্পাসটা দিনরাত যেখানে কাটা ফিরিয়ে আছে সেইখানে, তোমার মার্শম্যান সাহেবের হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়ার মধ্যে নয় ।” বিনয় । তোমার কাটা যে দিকে, সে দিকে কিছু একটা আছে কি ? গোরা উত্তেজিত হইয়া কহিল, “আছে না তো কী— আমি পথ ভুলতে পারি, ডুবে মরতে পারি, কিন্তু আমার সেই লক্ষ্মীর বন্দরটি আছে। সেই আমার পূর্ণস্বরূপ ভারতবর্ষ— ধনে পূর্ণ, জ্ঞানে পূর্ণ, ধর্মে পূর্ণ— সে ভারতবর্ষ কোথাও নেই ! আছে কেবল চারি দিকের এই মিথ্যেটা ! এই তোমার কলকাতা শহর, এই আপিস, এই আদালত, এই গোটাকতক ইটকাঠের বুদবুদ ! ছেঃ !” বলিয়া গোরা বিনয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টি কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল— বিনয় কোনো উত্তর না করিয়া ভাবিতে লাগিল। গোরা কহিল, “এই যেখানে আমরা পড়ছি শুনছি, চাকরির উমেদারি করে বেড়াচ্ছি, দশটা-পাঁচটায় ভূতের খাটুনি খেটে কী যে করছি তার কিছুই ঠিকানা নেই, এই জাদুকরের মিথ্যে ভারতবর্ষটাকেই আমরা সত্য বলে ঠাউরেছি বলেই পঁচিশ কোটি লোক মিথ্যে মানকে মান ব’লে, মিথ্যে কর্মকে কর্ম বলে দিনরাত বিভ্রান্ত হয়ে বেড়াচ্ছি- এই মরীচিকার ভিতর থেকে কি আমরা কোনোরকম চেষ্টায় প্ৰাণ পাব ! আমরা তাই প্ৰতিদিন শুকিয়ে মরছি । একটি সত্য ভারতবর্ষ। আছে— পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ, সেইখানে স্থিতি না হলে আমরা কি বুদ্ধিতে কি হৃদয়ে যথার্থ প্রাণরসটা টেনে নিতে পারব না। তাই বলছি, আর সমস্ত ভুলে, কেতাবের বিদ্যে, খেতাবের মায়া, 'উদ্ধৃবৃত্তির প্রলোভন, সব টান মেরে ফেলে দিয়ে সেই বন্দরের দিকেই জাহাজ ভাসাতে হবে- ডুবি তো ডুবাব, মরি তো মরব। সাধে আমি ভারতবর্ষের সত্য মূর্তি, পূর্ণ মূর্তি কোনোদিন ভুলতে পারি নে!” বিনয় । এ-সব কেবল উত্তেজনার কথা নয় ? এ তুমি সত্য বলছ ? গোরা মেঘের মতো গৰ্জিয়া কহিল, “সত্যই বলছি।” বিনয় । যারা তোমার মতো দেখতে পাচ্ছে না ? গোরা মুঠা বাধিয়া কহিল, “তাদের দেখিয়ে দিতে হবে। এই তো আমাদের কাজ। সত্যের ছবি স্পষ্ট না দেখতে পেলে লোকে আত্মসমৰ্পণ করবে। কোন উপছায়ার কাছে ? ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধরো— লোকে তা হলে পাগল হয়ে যাবে। তখন কি দ্বারে দ্বারে চাঁদা সোধে বেড়াতে হবে ? প্ৰাণ দেবার জন্যে ঠেলা ঠেলি পড়ে যাবে।” বিনয় । হয় আমাকে সংসারের দশ জনের মতো ভেসে চলে যেতে দাও। নইলে আমাকে সেই মূর্তি २९६ | গোরা । সাধনা করো। যদি বিশ্বাস মনে থাকে তা হলে কঠোর সাধনাতেই সুখ পাবে। আমাদের শৌখিন পেট্ৰিফুটুদের সত্যকার বিশ্বাস কিছুই নেই, তাই তারা নিজের এবং পরের কাছে কিছুই জাের করে দাবি করতে পারেন না। স্বয়ং কুবের যদি তাদের সেধে বর দিতে আসেন তা হলে তারা বােধ হয় লাটসাহেবের চাপরাশির গিলটি-করা তকমাটার চেয়ে বেশি আর কিছু সাহস করে চাইতেই পারেন না | তাদের বিশ্বাস নেই, তাই ভরসা নেই।