পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8の8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পৌত্তলিকতার অভিমুখে পিছাইয়া পড়িতেছে। র্তাহার বড়ো মেয়ের নাম লাবণ্য । সে মোটাসোটা, হাসিখুশি, লোকের সঙ্গ এবং গল্পগুজব ভালোবাসে। মুখটি গোলগাল, চোখ দুটি বড়ো, বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম । বেশভূষার ব্যাপারে সে স্বভাবতই কিছু চিলা, কিন্তু এ সম্বন্ধে তাহার মাতার শাসনে তাহাকে চলিতে হয়। উচু গােড়ালির জুতা পরিতে সে সুবিধা বোধ করে না, তবু না পরিয়া উপায় নাই। বিকালে সাজ করিবার সময় মা স্বহস্তে তাহার মুখে পাউডার ও দুই গালে রঙ লাগাইয়া দেন। একটু মোটা বলিয়া বরদাসুন্দরী তাহার জামা এমনি আঁট করিয়া তৈরি করিয়াছেন যে, লাবণ্য যখন সাজিয়া বাহির হইয়া আসে তখন মনে হয় যেন তাহাকে পাটের বস্তার মতো কলে চাপ দিয়া আঁটিয়া বাধা হইয়াছে । মেজো মেয়ের নাম ললিতা । সে বড়ো মেয়ের বিপরীত বলিলেই হয় । তাহার দিদির চেয়ে সে মাথায় লম্বা, রোগা, রঙ আর-একটু কালো, কথাবার্তা বেশি কয় না, সে আপনার নিয়মে চলে, ইচ্ছা! করিলে কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিতে পারে। বরদাসুন্দরী তাহাকে মনে মনে ভয় করেন, সহজে তাহাকে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে সাহস করেন না । ছোটাে লীলা, তাহার বয়স বছর দশেক হইবে। সে দৌড়ধাপ উপদ্রব করিতে মজবুত। সতীশের সঙ্গে তাহার ঠেলাঠেলি মারামারি সর্বদাই চলে। বিশেষত খুদে-নামধারী কুকুরটার স্বত্বাধিকার লইয়া উভয়ের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো মীমাংসা হয় নাই। কুকুরের নিজের মত লইলে সে বোধ হয় উভয়ের মধ্যে কাহাকেও প্রভুরূপে নির্বাচন করিত না ; তবু দুজনের মধ্যে সে বোধ করি সতীশকেই কিঞ্চিৎ পছন্দ করে । কারণ, লীলার আদরের বেগ সংবরণ করা এই ছোটো জন্তুটার পক্ষে সহজ ছিল না। বালিকার আদরের চেয়ে বালকের শাসন তাহার কাছে অপেক্ষাকৃত সুসহ ছিল । কহিলেন, “এরই বাড়িতে সেদিন আমরা-” বরদা কহিলেন, “ওঃ ! বড়ো উপকার করেছেন- আপনি আমাদের অনেক ধন্যবাদ জানবেন।” শুনিয়া বিনয় এত সংকুচিত হইয়া গেল যে ঠিকমত উত্তর দিতে পারিল না। মেয়েদের সঙ্গে যে যুবকটি আসিয়াছিল তাহার সঙ্গেও বিনয়ের আলাপ হইয়া গেল। তাহার নাম সুধীর । সে কলেজে বি. এ. পড়ে। চেহারাটি প্রিয়দর্শন, রঙ গীের, চোখে চশমা, অল্প গোফের রেখা উঠিয়াছে। ভাবখানা অত্যন্ত চঞ্চল— এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে চায় না, একটা কিছু করিবার জন্য ব্যস্ত। সর্বদাই মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা করিয়া, বিরক্ত করিয়া, তাহাদিগকে অস্থির করিয়া রাখিয়াছে। মেয়েরাও তাহার প্রতি কেবলই তর্জন করিতেছে, কিন্তু সুধীরকে নহিলে তাঁহাদের কোনোমতেই চলে না। সার্কাস দেখাইতে, জুঅলজিকাল গার্ডেনে লইয়া যাইতে, কোনো শখের জিনিস কিনিয়া আনিতে, সুধীর সর্বদাই প্রস্তুত । মেয়েদের সঙ্গে সুধীরের অসংকোচ হৃদ্যতার ভাব বিনয়ের কাছে অত্যন্ত নূতন এবং বিস্ময়কর ঠেকিল। প্রথমটা সে এইরূপ ব্যবহারকে মনে মনে নিন্দাই করিল, কিন্তু সে নিন্দার সঙ্গে একটু যেন ঈর্ষার ভাব মিশিতে লাগিল । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “মনে হচ্ছে আপনাকে যেন দুই-একবার সমাজে দেখেছি।” বিনয়ের মনে হইল যেন তাহার কী একটা অপরাধ। ধরা পড়িল । সে অনাবশ্যক লজ্জা প্ৰকাশ করিয়া কহিল, “হা, আমি কেশববাবুর বক্তৃতা শুনতে মাঝে মাঝে যাই।” বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি বুঝি কলেজে পড়ছেন ?” বিনয় কহিল, “না, এখন আর কলেজে পড়ি নে ৷” বরদা কহিলেন, “আপনি কলেজে কতদূর পর্যন্ত পড়েছেন ?” বিনয় কহিল, “এম. এ. পাস করেছি।” শুনিয়া এই বালকের মতো চেহারা যুবকের প্রতি বরদাসুন্দরীর শ্রদ্ধা হইল। তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া পরেশের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আমার মনু যদি থাকত। তবে সেও এতদিনে এম. এ. পাস করে বের झूठ ।