পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Or রবীন্দ্র-রচনাবলী সুচরিতার অত্যন্ত ইচ্ছা করিতে লাগিল কেহ এই উদ্ধত যুবককে তর্কে একেবারে পরাস্ত লাঞ্ছিত করিয়া দেয়। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া গোরার কথা শুনিতেছে দেখিয়া তাহার মনে মনে রাগ হইল । গোরা এতই জোরের সঙ্গে কথা বলিতেছিল যে, এই জোরকে নত করিয়া দিবার জন্য সুচরিতার মনের মধ্যেও যেন জোর করিতে লাগিল । এমন সময়ে বেহার চায়ের জন্য। কাৎলিতে গরম জল আনিল । সুচরিতা উঠিয়া চা তৈরি করিতে নিযুক্ত হইল। বিনয় মাঝে মাঝে চকিতের মতো সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া লইল। যদিচ উপাসনা সম্বন্ধে গোরার সঙ্গে বিনয়ের মতের বিশেষ পার্থক্য ছিল না, তবু গোরা যে এই ব্ৰাহ্ম-পরিবারের মাঝখানে অনাহুত আসিয়া বিরুদ্ধ মত এমন অসংকোচে প্রকাশ করিয়া যাইতেছে ইহাতে বিনয়কে পীড়া দিতে লাগিল। গােরার এইপ্ৰকার যুদ্ধোদ্যত আচরণের সহিত তুলনা করিয়া বৃদ্ধ পরেশের একটি ভক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। সে মনে মনে বলিতে লাগিল, মতামত কিছুই নয়— আন্তঃকরণের মধ্যে পূর্ণতা স্তব্ধতা ও আত্মপ্রসাদ ইহাই সকলের চেয়ে দুর্লভ। কথাটার মধ্যে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তাহা লইয়া যতই তর্ক করা-না কেন, প্ৰাপ্তির মধ্যে যেটা সত্য সেইটাই আসল । পরেশ সকল কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে এক-একবার চােখ বুজিয়া নিজের অন্তরের মধ্যে তলাইয়া লইতেছিলেন- ইহা র্তাহার অভ্যাস- তাহার সেই-সময়কার অন্তনিবিষ্ট শান্ত মুখশ্ৰী বিনয় একদৃষ্টি দেখিতেছিল । গোরা যে এই বৃদ্ধের প্রতি ভক্তি অনুভব করিয়া নিজের বাক্য সংযত করিতেছিল না, ইহাতে বিনয় বড়োই আঘাত পাইতেছিল । সুচরিত কয়েক পেয়ালা চা তৈরি করিয়া পরেশের মুখের দিকে চাহিল। কাহাকে চা খাইতে অনুরোধ করিবে না-করিবে তাহা লইয়া তাহার মনে দ্বিধা হইতেছিল। বরদাসুন্দরী গোরার দিকে চাহিয়াই একেবারে বলিয়া বসিলেন, “আপনি এ-সমস্ত কিছু খাবেন না বুঝি ?” গোরা কহিল, “না ।” বরদা । কেন ? জাত যাবে ? গোরা বলিল, “ই ।” বরদা । আপনি জাত মানেন ! গোরা । জাত কি আমার নিজের তৈরি যে মানব না ? সমাজকে যখন মানি তখন জাতও মানি । বরদা । সমাজকে কি সব কথায় মানতেই হবে ? গোরা । না মানলে সমাজকে ভাঙা হয় | বরদা । ভাঙলে দোষ কী ? গোরা । যে ডালে সকলে মিলে বসে আছি সে ডাল কাটলেই বা দোষ কী ? সুচরিতা মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, “মা, মিছে তর্ক করে লাভ কী ? উনি আমাদের ছোওয়া খাবেন না ।” গোরা সুচরিতার মুখের দিকে তাহার প্রখর দৃষ্টি একবার স্থাপিত করিল। সুচরিতা বিনয়ের দিকে চাহিয়া ঈষৎ সংশয়ের সহিত কহিল, “আপনি কি-” বিনয় কোনোকালে চা খায় না। মুসলমানের তৈরি পাউরুটি-বিস্কুট খাওয়াও অনেক দিন ছাড়িয়া দিয়াছে কিন্তু আজ তাহার না খাইলে নয়। সে জোর করিয়া মুখ তুলিয়া বলিল,“হী, খাব বৈকি।” বলিয়া গোরার মুখের দিকে চাহিল। গোরার ওষ্ঠ্যপ্রান্তে ঈষৎ একটু কঠোর হাসি দেখা দিল। বিনয়ের মুখে চা তিতো ও বিস্বাদ লাগিল, কিন্তু সে খাইতে ছাড়িল না। বরদাসুন্দরী মনে মনে বলিলেন, “আহা, এই বিনয় ছেলেটি বড়ো ভালো।” তখন তিনি গোরার দিক হইতে একেবারেই মুখ ফিরাইয়া বিনয়ের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন । তাই দেখিয়া পরেশ আস্তে আস্তে গোরার কাছে তাহার চৌকি টানিয়া লইয়া তাহার সঙ্গে মৃদুস্বরে আলাপ করিতে লাগিলেন ।