পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8O& এমন সময় রাস্তা দিয়া চিনেবাদামওয়ালা গরম চিনেবাদামভাজা হাকিয়া যাইতেই লীলা হাততালি দিয়া উঠিল ; কহিল, “সুধীরদা, চিনেবাদাম ডাকো ।” বলিতেই ছাতের বারান্দা ধরিয়া সতীশ চিনাবাদামওয়ালাকে ডাকিতে লাগিল । ইতিমধ্যে আর-একটি ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তঁহাকে সকলেই পানুবাবু বলিয়া সম্ভাষণ করিল, কিন্তু তাহার আসল নাম হারানচন্দ্ৰ নাগ। দলের মধ্যে ইহার বিদ্বান ও বুদ্ধিমান বলিয়া বিশেষ খ্যাতি আছে। যদিও স্পষ্ট করিয়া কোনো পক্ষই কোনো কথা বলে নাই, তথাপি ইহার সঙ্গেই সুচরিতার বিবাহ হইবে এই প্রকারের একটা সম্ভাবনা আকাশে ভাসিতেছিল। পানুবাবুর হৃদয় যে সুচরিতার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল তাহাতে কাহারও সন্দেহ ছিল না এবং ইহাই লইয়া মেয়েরা সুচরিতাকে সর্বদা ঠাট্টা করিতে ছাড়িত না । পানুবাবু ইস্কুলে মাস্টারি করেন। বরদাসুন্দরী র্তাহাকে ইস্কুল-মাস্টার মাত্র জানিয়া বড়ো শ্রদ্ধা করেন না। তিনি ভাবে দেখান যে, পানুবাবু যে র্তাহার কোনো মেয়ের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করিতে সাহস করেন নাই সে ভালোই হইয়াছে। র্তাহার ভাবী জামাতারা ডেপুটিগরির লক্ষ্যবোধরােপ অতি দুঃসাধ্য পণে আবদ্ধ। p সুচরিতা হারানকে এক পেয়ালা চা অগ্রসর করিয়া দিতেই লাবণ্য দূর হইতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু মুখ টিপিয়া হাসিল। সেই হাসিটুকু বিনয়ের অগোচর রহিল না। অতি অল্প কালের মধ্যেই দুই-একটা বিষয়ে বিনয়ের নজর বেশ একটু তীক্ষ এবং সতর্ক হইয়া উঠিয়াছে— দর্শননৈপুণ্য সম্বন্ধে পূর্বে সে প্রসিদ্ধ ছিল না। এই যে হারান ও সুধীর এ-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে অনেক দিন হইতে পরিচিত, এবং এই পারিবারিক ইতিহাসের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত যে তাহারা মেয়েদের মধ্যে পরস্পর ইঙ্গিতের বিষয় হইয়া পড়িয়ছে, বিনয়ের বুকের মধ্যে ইহা বিধাতার অবিচার বলিয়া বাজিতে লাগিল । এ দিকে হারানের অভ্যাগমে সুচরিতার মন যেন একটু আশান্বিত হইয়া উঠিল। গোরার স্পর্ধা তার্কিকতায় সে অনেক বার বিরক্ত হইয়াছে, কিন্তু আজ এই তর্কবীরকে দেখিয়া সে আনন্দের সঙ্গে তাহাকে চা ও পাউরুটির রসদ জোগাইয়া দিল । পরেশ कश्लि, “পানুবাবু, ইনি আমাদের-" হারান কহিলেন, “ওঁকে বিলক্ষণ জানি। উনি এক সময়ে আমাদের ব্রাহ্মসমাজের একজন খুব উৎসাহী সভ্য ছিলেন ।” এলিয়া গাের সঙ্গ কােনােপ্রকার আলাপের চীন কক্স হানচলে পোেলর প্রতিজ্ঞ সেই সময়ে দুই-এক জন মাত্র বাঙালি সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হইয়া এ দেশে আসিয়াছেন। সুধীর তঁহাদেরই একজনের অভ্যর্থনার গল্প তুলিল। হারান কহিলেন, “পরীক্ষায় বাঙালি যতই পাস করুন, বাঙালির দ্বারা কোনো কাজ হবে না ।” কোনো বাঙালি ম্যাজিষ্ট্রেট বা জজ ডিষ্টিক্টের ভার লইয়া যে কখনো কাজ চালাইতে পরিবে না, ছু পৃদ্ধ করার জন্য হািন বাঙািলর চরিত্রে কের দােষ ও দুৰ্বলতার বাধা করতে See দেখিতে দেখিতে গোরার মুখ লাল হইয়া উঠিল— সে তাহার সিংহনাদকে যথাসাধ্য রুদ্ধ করিয়া কহিল, “এই যদি সত্যই আপনার মত হয় তবে আপনি আরামে এই টেবিলে বসে বসে পাউরুটি চিবোচ্ছেন কোন লজ্জায় !" হারান বিস্মিত হইয়া ভুরু তুলিয়া কহিলেন, “কী করতে বলেন ?” গােরা। হয় বাঙালি-চরিত্রের কলঙ্ক মােচন করুন, নয় গলায় দড়ি দিয়ে মরুন গে। আমাদের জাতের দ্বারা কখনো কিছুই হবে না, এ কথা কি এতই সহজে বলবার ? আপনার গলায় রুটি