পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Sb. রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দময়ী । তোমাকে এইখানেই খেতে হবে । বিনয় একবার গোরার মুখের দিকে চাহিল। গোরা কহিল, “বিনয়, অনেক দিন বাঁচবে। তোমার ওখানেই ן" আনন্দময়ীর বুক হালকা হইয়া গেলা— তিনি তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেলেন। দুই বন্ধু ঘরে আসিয়া বসিলে গোরা যাহা-তােহা একটা কথা তুলিল— কহিল, “জান, আমাদের ছেলেদের জন্যে একজন বেশ ভালো জিমনাস্টিক মাস্টার পেয়েছি। সে শেখাচ্ছে বেশ ।” মনের ভিতরের আসল কথাটা এখনো কেহ পাড়িতে সাহস করিল না। দুই জনে যখন খাইতে বসিয়া গেল তখন আনন্দময়ী তাঁহাদের কথাবার্তায় বুঝিতে পারিলেন এখনো তাহাদের উভয়ের মধ্যে বাধো-বাধো রহিয়াছে। পর্দা উঠিয়া যায় নাই। তিনি কহিলেন, “বিনয়, রাত অনেক হয়েছে, তুমি আজ এইখানেই শুয়ো । আমি তোমার বাসায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বিনয় চকিতের মধ্যে গোরার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “ভুক্তব্য রাজবদাচারেৎ । খেয়ে রাস্তায় ইটা নিয়ম নয় । তা হলে এইখানেই শোয়া যাবে।” আহারান্তে দুই বন্ধু ছাতে আসিয়া মাদুর পতিয়া বসিল । ভাদ্র মাস পড়িয়ছে ; শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসিয়া যাইতেছে। হালকা পাতলা সাদা মেঘ ক্ষণিক ঘুমের ঘোরের মতো মাঝে মাঝে চাদকে একটুখানি ঝাপসা করিয়া দিয়া আস্তে আস্তে উড়িয়া চলিতেছে। চারিদিকে দিগন্ত পর্যন্ত নানা আয়তনের উচু-নিচু ছাতের শ্রেণী ছায়াতে আলোতে এবং মাঝে মাঝে গাছের মাথার সঙ্গে মিশিয়া যেন সম্পূর্ণ প্রয়োজনহীন একটা প্ৰকাণ্ড অবাস্তব খেয়ালের মতো পড়িয়া রহিয়াছে। গির্জার ঘড়িতে এগারোটর ঘণ্টা বাজিল ; বরফওয়ালা তাহার শেষ হক হঁকিয়া চলিয়া গেল । গাড়ির শব্দ মন্দ হইয়া আসিয়াছে। গোরাদের গলিতে জাগরণের লক্ষণ নাই, কেবল প্রতিবেশীর আস্তাবলে কাঠের মেঝের উপর ঘোড়ার খুরের শব্দ এক-এক বার শোনা যাইতেছে এবং কুকুর ঘেউ ঘেউ করিয়া উঠিতেছে । দুই জনে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে বিনয় প্রথমটা একটু দ্বিধা করিয়া অবশেষে পরিপূর্ণবেগে তাহার মনের কথাকে বন্ধনমুক্ত করিয়া দিল। বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি জানি এ-সব বিষয়ে তোমার মন নেই, কিন্তু তোমাকে না বললে আমি বঁচব না। আমি ভালো মন্দ কিছুই বুঝতে পারছি নে- কিন্তু এটা নিশ্চয় এর সঙ্গে কোনো চাতুরী খাটবে না। বইয়েতে অনেক কথা পড়েছি এবং এতদিন মনে করে এসেছি। সব জানি । ঠিক যেন ছবিতে জল দেখে মনে করতুম সীতার দেওয়া খুব সহজ- কিন্তু আজ জলের মধ্যে পড়ে এক মুহুর্তে বুঝতে পেরেছি, এ তো ফাকি নয় ।” এই বলিয়া বিনয় তাহার জীবনের এই আশ্চর্য আবির্ভাবকে একান্ত চেষ্টায় গোরার সম্মুখে উদঘাটিত করিতে লাগিল । বিনয় বলিতে লাগিল, আজকাল তাহার কাছে সমস্ত দিন ও রাত্রির মধ্যে কোথাও যেন কিছু ফাক নাই- সমস্ত আকাশের মধ্যে কোথাও যেন কোনো রন্ধ নাই, সমস্ত একেবারে নিবিড়ভাবে ভরিয়া গেছে— বসন্তকালের মউচাক যেমন মধুতে ভরিয়া ফাটিয়া যাইতে চায়, তেমনিতরো। আগে এই সেইটুকুতেই তাহার দৃষ্টি বদ্ধ ছিল। আজ সমস্তই তাহার সম্মুখে আসিতেছে, সমস্তই তাহাকে স্পর্শ করিতেছে, সমস্তই একটা নূতন অর্থে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সে জানিত না পৃথিবীকে সে এত ভালোবাসে, আকাশ এমন আশ্চর্য, আলোক এমন অপূর্ব, রাস্তার অপরিচিত পথিকের প্রবাহও এমন গভীরভাবে সত্য। তাহার ইচ্ছা করে সকলের জন্য সে একটা-কিছু করে, তাহার সমস্ত শক্তিকে আকাশের সূর্যের মতো সে জগতের চিরন্তন সামগ্ৰী করিয়া তোলে। বিনয় যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গে এই সমস্ত কথা বলিতেছে তাহা হঠাৎ মনে হয় না । সে যেন কাহারও নাম মুখে আনিতে পারে না- আভাস দিতে গেলেও কুষ্ঠিত হইয়া পড়ে। এই-থে