পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী 昂 করতে দাড়িয়েছ।” গোরা অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “বিনয়, তুমি মুখে মুখে বই রচনা কোরো না । তোমার কথা শুনে আমি একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, তোমার জীবনে তুমি আজ একটা প্রবল সত্যের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছ- তার সঙ্গে ফাকি চলে না। সত্যকে উপলব্ধি করলেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে- সে আর থাকবার জো নেই। আমি যে ক্ষেত্রে দাড়িয়েছি সেই ক্ষেত্রের সন্তাকেও অমনি করেই একদিন আমি উপলব্ধি করব। এই আমার আকাঙক্ষা । তুমি এতদিন বই-পড়া প্রেমের পরিচয়েই পরিতৃপ্ত ছিলে— আমিও বই-পড়া স্বদেশপ্রেমকেই জানি— প্ৰেম আজ তোমার কাছে যখনই প্রত্যক্ষ হল তখনই বুঝতে পেরেছ বইয়ের জিনিসের চেয়ে এ কত সত্য- এ তোমার সমস্ত জগৎ-চরাচর অধিকার করে বসেছে, কোথাও তুমি এর কাছ থেকে নিস্কৃতি পােচ্ছ না- স্বদেশপ্রেম যেদিন আমার সম্মুখে এমনি সর্বাঙ্গীণভাবে প্রত্যক্ষগোচর হবে সেদিন আমারও আর রক্ষা নেই। সেদিন সে আমার ধনপ্রাণ, আমার অস্থিমজ্জােরক্ত, আমার আকাশ-আলোক, আমার সমস্তই অনায়াসে আকর্ষণ করে নিতে পারবে। স্বদেশের সেই সত্যমূর্তি যে কী আশ্চর্য অপরূপ, কী সুনিশ্চিত সুগোচর, তার আনন্দ তার বেদনা যে কী প্ৰচণ্ড প্রবল, যা বন্যার স্রোতের মতো জীবন-মৃত্যুকে এক মুহুর্তে লঙঘন করে যায়, তা আজ তোমার কথা শুনে মনে মনে অল্প অল্প অনুভব করতে পারছি। তোমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে আজ আঘাত করেছে— তুমি যা পেয়েছ তা আমি কোনােদিন বুঝতে পারব কি না জানি না— কিন্তু আমি যা পেতে চাই তার আস্বাদ যেন তোমার ভিতর দিয়েই আমি অনুভব করছি।” বলিতে বলিতে গোরা মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। পূর্ব দিকের উষার আভাস তাহার কাছে যেন একটা বাক্যের মতো, বার্তার মতো প্ৰকাশ পাইল ; যেন প্ৰাচীন তপোবনের একটা বেদমন্ত্রের মতো উচ্চারিত হইয়া উঠিল; তাহার সমস্ত শরীরে কঁটা দিল- মুহুর্তের জন্য সে স্তম্ভিত হইয়া দাড়াইল, এবং ক্ষণকালের জন্য তাহার মনে হইল তাহার ব্ৰহ্মরন্ধ ভেদ করিয়া একটি জ্যোতিলেখা সূক্ষ্ম মৃণালের ন্যায় উঠিয়া একটি জ্যোতির্ময় শতদলে সমস্ত আকাশে পরিব্যাপ্ত হইয়া বিকশিত হইল- তাহার সমস্ত প্ৰাণ, সমস্ত চেতনা, সমস্ত শক্তি যেন ইহাতে একেবারে পরম আনন্দে নিঃশেষিত হইয়া গেল । গােরা যখন আপনাতে আপনি ফিরিয়া আসিল তখন সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “বিনয়, তােমার এ প্রেমকেও পার হয়ে আসতে হবে- আমি বলছি, ওখানে থামলে চলবে না। আমাকে যে মহাশক্তি আহবান করছেন তিনি যে কত বড়ো সত্য একদিন তোমাকে আমি তা দেখাব | আমার মনের মধ্যে আজ ভরি আনন্দ হচ্ছে- তোমাকে আজ আমি আর কারও হাতে ছেড়ে দিতে পারব না।” বিনয় মাদুর ছাড়িয়া উঠিয়া গোরার কাছে আসিয়া দাড়াইল। গোরা তাহাকে একটা অপূর্ব উৎসাহে দুই হাত দিয়া বুকে চাপিয়া ধরিল— কহিল, “ভাই বিনয়, আমরা মরব, এক মরণে মরব। আমরা দুজনে এক, আমাদের কেউ বিচ্ছিন্ন করবে না, কেউ বাধা দিতে পারবে না।” গোরার এই গভীর উৎসাহের বেগ বিনয়েরও হৃদয়ের মধ্যে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল ; সে কোনো কথা না বলিয়া গোরার এই আকর্ষণে আপনাকে ছাড়িয়া দিল । গোরা বিনয় দুই জনে নীরবে পাশাপাশি বেড়াইতে লাগিল। পূর্বকাশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। গোরা কহিল, “ভাই, আমার দেবীকে আমি যেখানে দেখতে পাচ্ছি। সে তো সৌন্দর্যের মাঝখানে নয়সেখানে দুর্ভিক্ষ দারিদ্র্য, সেখানে কষ্ট আর অপমান। সেখানে গান গেয়ে, ফুল দিয়ে পুজো নয় ; সেখানে প্ৰাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে পুজো করতে হবে- আমার কাছে সেইটেই সব চেয়ে বড়ো আনন্দ মনে হচ্ছে- সেখানে সুখ দিয়ে ভোলাবার কিছু নেই- সেখানে নিজের জোরে সম্পূর্ণ জগতে হবে, সম্পূর্ণ দিতে হবে- মাধুর্য নয়, এ একটা দুৰ্জয় দুঃসহ আবির্ভাব- এ নিষ্ঠুর, এ ভয়ংকর-এর মধ্যে সেই কঠিন ঝংকার আছে যাতে করে সপ্তসুর একসঙ্গে বেজে উঠে তার ছিড়ে পড়ে যায়। মনে করলে আমার বুকের মধ্যে উল্লাস জেগে ওঠে- আমার মনে হয়, এই আনন্দই পুরুষের আনন্দ- এই হচ্ছে