পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88总 রবীন্দ্র-রচনাবলী তুমি মেয়েদের সম্বন্ধে এক মুহুৰ্তও ভাব না- দেশকে তুমি যেন নারীহীন করে জান- সেরকম জানা কখনোই সত্য জানা নয় । গোরা । আমি যখন আমার মাকে দেখেছি, মাকে জেনেছি, তখন আমার দেশের সমস্ত স্ত্রীলোককে সেই এক জায়গায় দেখেছি এবং জেনেছি। বিনয় । ওটা তুমি নিজেকে ভোলাবার জন্যে একটা সাজিয়ে কথা বললে মাত্র। ঘরের কাজের মধ্যে ঘরের লোকে ঘরের মেয়েদের অতিপরিচিত ভাবে দেখলে তাতে যথার্থ দেখাই হয় না । নিজেদের গাৰ্হস্থ্য প্রয়োজনের বাইরে আমরা দেশের মেয়েদের যদি দেখতে পেতুম তা হলে আমাদের স্বদেশের সৌন্দর্য এবং সম্পূর্ণতাকে আমরা দেখতুম, দেশের এমন একটি মূর্তি দেখা যেত যার জন্য প্ৰাণ দেওয়া সহজ হত— অন্তত, তা হলে দেশের মেয়েরা যেন কোথাও নেই এরকম ভুল আমাদের কখনোই ঘটতে পারত না। জানি ইংরেজের সমাজের সঙ্গে কোনোরকম তুলনা করতে গেলেই তুমি আগুন হয়ে উঠবে- আমি তা করতে চাই নে— আমি জানি নে ঠিক কতটা পরিমাণে এবং কী রকম ভাবে আমাদের মেয়ের সমাজে প্ৰকাশ পেলে তাদের মর্যাদা লঙঘন হয় না, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, মেয়েরা প্রচ্ছন্ন থাকাতে আমাদের স্বদেশ আমাদের কাছে অর্ধসতা হয়ে আছে- আমাদের হৃদয়ে পূর্ণপ্রেম এবং পূর্ণশক্তি দিতে পারছে না। গোরা। তুমি এ কথাটা সম্প্রতি হঠাৎ আবিষ্কার করলে কী করে ? বিনয় । হা, সম্প্রতিই আবিষ্কার করেছি এবং হঠাৎ আবিষ্কারই করেছি। এতবড়ো সত্য আমি এতদিন জানতুম না | জানতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলেই মনে করছি। আমরা যেমন চাষাকে কেবলমাত্র তার চাষবাস, তাতিকে তার কাপড়-তৈরির মধ্যে দেখি বলে তাদের ছোটােলোক বলে অবজ্ঞা করি, তারা সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের চােখে পড়ে না, এবং মেয়েদের কেবল তাদের রান্নাবান্না বাটনা-বাটার মধ্যে আবদ্ধ করে দেখছি বলেই মেয়েদের মেয়েমানুষ বলে অত্যন্ত খাটো করে দেখি- এতে করে আমাদের সমস্ত দেশই খাটো হয়ে গেছে। গোরা । দিন আর রাত্রি, সময়ের এই যেমন দুটাে ভাগ- পুরুষ এবং মেয়েও তেমনি সমাজের দুই অংশ। সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় স্ত্রীলোক রাত্রির মতোই প্রচ্ছন্ন— তার সমস্ত কাজ নিগুঢ় এবং নিভৃত । আমাদের কর্মের হিসাব থেকে আমরা রাতকে বাদ দিই। কিন্তু বাদ দিই বলে তার যে গভীর কর্ম তার কিছুই বাদ পড়ে না। সে গোপন বিশ্রামের অন্তরালে আমাদের ক্ষতিপূরণ করে, আমাদের পোষণের সহায়তা করে । যেখানে সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থা সেখানে রাতকে জোর করে দিন করে তোলে- সেখানে গ্যাস জ্বালিয়ে কল চালানো হয়, বাতি জ্বালিয়ে সমস্ত রাত নাচ-গান হয়- তাতে ফল কী হয় ! ফল এই হয় যে, রাত্রির যে স্বাভাবিক নিভৃত কাজ তা নষ্ট হয়ে যায়, ক্লান্তি বাড়তে থাকে, ক্ষতিপূরণ হয় না, মানুষ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মেয়েদেরও যদি তেমনি আমরা প্রকাশ্য কর্মক্ষেত্রে টেনে আনি তা হলে তাদের নিগুঢ় কর্মের ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়— তাতে সমাজের স্বাস্থ্য ও শান্তি-ভঙ্গ হয়, সমাজে একটা মত্ততা প্রবেশ করে। সেই মত্ততাকে হঠাৎ শক্তি বলে ভ্ৰম হয়, কিন্তু সে শক্তি বিনাশ করবারই শক্তি। শক্তির দুটাে অংশ আছে- এক অংশ ব্যক্ত আর-এক অংশ অব্যক্ত, এক অংশ উদ্যোগ আর-এক অংশ বিশ্রাম, এক অংশ প্রয়োগ আর-এক অংশ সংবরণ- শক্তির এই সামঞ্জস্য যদি নষ্ট কর তা হলে সে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু সে ক্ষোভ মঙ্গলকর নয়। নরনারী সমাজশক্তির দুই দিক ; পুরুষই ব্যক্ত, কিন্তু ব্যক্ত বলেই যে মস্ত তা নয়- নারী অব্যক্ত, এই অব্যক্ত শক্তিকে যদি কেবলই ব্যক্ত করবার চেষ্টা করা হয় তা হলে সমস্ত মূলধন খরচ করে ফেলে সমাজকে দ্রুতবেগে দেউলে করবার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেইজন্যে বলছি আমরা পুরুষরা যদি থাকি যজ্ঞের ক্ষেত্রে, মেয়েরা যদি থাকেন ভাড়ার আগলে, তা হলেই মেয়েরা অদৃশ্য থাকলেও যজ্ঞ সুসম্পন্ন হবে । সব শক্তিকেই একই দিকে একই জায়গায় একই রকমে খরচ করতে চায় যারা তারা উন্মত্ত | বিনয়। গোরা, তুমি যা বললে আমি তার প্রতিবাদ করতে চাই নে- কিন্তু আমি যা বলছিলুম