পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী হইয়া সে ভারি আরাম বোধ করিল এবং বিনয়বাবুকে অসামান্য ভালো লোক বলিয়া মনে করিতে তাহার কোনো বাধা রহিল না । হারানবাবুও বিনয়ের প্রতি বিমুখ হইলেন না— তিনি একটু যেন বেশি করিয়া স্বীকার করিলেন যে বিনয়ের ভদ্রতাঙ্ঞান আছে। গোরার যে সেটা নাই। ইহাই এই স্বীকারোক্তির ইঙ্গিত । বিনয় কখনো হারানবাবুর সম্মুখে কোনো তর্কের বিষয় তুলিত না এবং সুচরিতারও চেষ্টা ছিল যাহাতে না তোলা হয়- এইজন্য বিনয়ের দ্বারা ইতিমধ্যে চায়ের টেবিলের শান্তিভঙ্গ হইতে পায় कारैि | আলোচনায় প্রবৃত্ত করিত। গোরা এবং বিনয়ের মতো শিক্ষিত লোক কেমন করিয়া যে দেশের প্রাচীন কুসংস্কারগুলি সমর্থন করিতে পারে ইহা জানিবার কৌতুহল কিছুতেই তাহার নিবৃত্তি হইত না। গােরা ও বিনয়কে সে যদি না জানিত তবে এ-সকল মত কেহ স্বীকার করে জানিলে সুচরিতা দ্বিতীয় কোনো কথা না শুনিয়া তাহাকে অবজ্ঞার যোগ্য বলিয়া স্থির করিত । কিন্তু গোরাকে দেখিয়া অবধি গোরাকে সে কোনােমতে মন হইতে অশ্রদ্ধা করিয়া দূর করিতে পারিতেছে না। তাই সুযোগ পাইলেই ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়ের সঙ্গে সে গোরার মত ও জীবনের আলোচনা উত্থাপন করে এবং প্রতিবাদের দ্বারা সকল কথা শেষ পর্যন্ত টানিয়া বাহির করিতে থাকে। পরেশ সুচরিতাকে সকল সম্প্রদায়ের মত শুনিতে দেওয়াই তাহার সুশিক্ষার উপায় বলিয়া জানিতেন, এইজন্য তিনি এ-সকল তর্কে কোনোদিন শঙ্কা অনুভব বা বাধা প্ৰদান করেন নাই। একদিন সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, গীেরমোহনবাবু কি সত্যই জাতিভেদ মানেন, না। ওটা দেশানুরাগের একটা বাড়াবাড়ি ?” বিনয় কহিল, “আপনি কি সিঁড়ির ধাপগুলোকে মানেন ? ওগুলোও তো সব বিভাগ- কোনোটা উপরে কোনোটা নীচে ।” সুচরিতা। নীচে থেকে উপরে উঠতে হয় বলেই মানি— নইলে মানবার কোনো প্রয়োজন ছিল না । সমান জায়গায় সিঁড়িকে না মানলেও চলে | বিনয় । ঠিক বলেছেন- আমাদের সমাজ একটা সিঁড়ি- এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হচ্ছে নীচে থেকে উপরে উঠিয়ে দেওয়া, মানবজীবনের একটা পরিণামে নিয়ে যাওয়া । যদি সমাজকে সংসারকেই পরিণাম বলে জানতুম তা হলে কোনো বিভাগব্যবস্থার প্রয়োজনই ছিল না- তা হলে যুরোপীয় সমাজের মতো প্রত্যেকে অন্যের চেয়ে বেশি দখল করবার জন্যে কড়াকড়ি মারামারি করে চলতুম ; সংসারে যে কৃতকার্য হত সেই মাথা তুলত, যার চেষ্টা নিস্ফল হত। সে একেবারেই তলিয়ে যেত। আমরা সংসারের ভিতর দিয়ে সংসারকে পার হতে চাই বলেই সংসারের কর্তব্যকে প্রবৃত্তি ও প্ৰতিযোগিতার উপরে প্রতিষ্ঠিত করি নি- সংসারকর্মকে ধর্ম বলে স্থির করেছি, কেননা কর্মের দ্বারা অন্য কোনো সফলতা নয়, মুক্তি লাভ করতে হবে, সেইজন্য এক দিকে সংসারের কাজ, অন্য দিকে সংসার-কাজের পরিণাম, উভয় দিকে তাকিয়ে আমাদের সমাজ বর্ণভেদ অর্থাৎ বৃত্তিভেদ স্থাপন করেছেন । , সুচরিতা। আমি যে আপনার কথা খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছি তা নয়। আমার প্রশ্ন এই যে, যে উদ্দেশ্যে সমাজের বর্ণভেদ প্রচলিত হয়েছে আপনি বলছেন সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন ? V বিনয়। পৃথিবীতে সফলতার চেহারা দেখতে পাওয়া বড়ো শক্ত। গ্ৰীসের সফলতা আজ গ্ৰীসের মধ্যে নেই, সেজন্যে বলতে পারি। নে গ্ৰীসের সমস্ত আইডিয়াই ভ্ৰান্ত এবং ব্যৰ্থ। গ্ৰীসের আইডিয়া এখনো মানবসমাজের মধ্যে নানা আকারে সফলতা লাভ করছে। ভারতবর্ষ যে জাতিভেদ বলে সামাজিক সমস্যার একটা বড়ো উত্তর দিয়েছিলেন, সে উত্তরটা এখনো মরে নি— সেটা এখনো পৃথিবীর সামনে রয়েছে। য়ুরোপও সামাজিক সমস্যার অন্য কোনাে সদুত্তর এখনাে দিতে পারে নি,