পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88や রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘূণা করে, দুঃখকে যে জয় করে, অভাবকে যে লক্ষ করে না, যে পরমে ব্ৰহ্মণি যোজিতচিত্তঃ । যে আটল, যে শান্ত, যে মুক্ত সেই ব্ৰাহ্মণকে ভারতবর্ষ চায়— সেই ব্ৰাহ্মণকে যথার্থভাবে পেলে তবেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। আমাদের সমাজের প্রত্যেক বিভাগকে প্রত্যেক কর্মকে সর্বদাই একটি মুক্তির সুর জোগাবার জন্যই ব্ৰাহ্মণকে চাই- রাধবার জন্যে এবং ঘণ্টা নাড়বার জন্যে নয়- সমাজের সার্থকতাকে সমাজের চোখের সামনে সর্বদা প্ৰত্যক্ষ করে রাখবার জন্যে ব্রাহ্মণকে চাই । এই ব্ৰাহ্মণের আদর্শকে আমরা যত বড়ো করে অনুভব করব ব্ৰাহ্মণের সম্মানকে তত বড়ো করে তুলতে হবে। সে সম্মান রাজার সম্মানের চেয়ে অনেক বেশি- সে সম্মান দেবতারই সম্মান । এ দেশে ব্ৰাহ্মণ যখন সেই সম্মানের যথার্থ অধিকারী হবে তখন এ দেশকে কেউ অপমানিত করতে পারবে না । আমরা কি রাজার কাছে মাথা হেঁট করি, অত্যাচারীর বন্ধন গলায় পরি ? নিজের ভয়ের কাছে আমাদের মাথা নত, নিজের লোভের জালে আমরা জড়িয়ে আছি, নিজের মুঢ়তার কাছে আমরা দাসানুদাস। ব্ৰাহ্মণ তপস্যা করুন ; সেই ভয় থেকে, লোভ থেকে, মুঢ়তা থেকে আমাদের মুক্ত করুন। আমরা তাদের কাছ থেকে যুদ্ধ চাই নে, বাণিজ্য চাই নে, আর কোনো প্রয়োজন চাই নে— তারা আমাদের সমাজের মাঝখানে মুক্তির সাধনাকে সত্য করে তুলুন। পরেশবাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, “ভারতবর্ষকে যে আমি জানি তা বলতে পারি। নে এবং ভারতবর্ষ যে কী চেয়েছিলেন এবং কোনোদিন তা পেয়েছিলেন কি না। তা আমি নিশ্চয় জানি নে, কিন্তু যে দিন চলে গেছে সেই দিনে কি কখনো ফিরে যাওয়া যায় ? বর্তমানে যা সম্ভব তাই আমাদের সাধনার বিষয়- অতীতের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলে কি কোনো কাজ হবে ?” বিনয় কহিল, “আপনি যেমন বলছেন আমিও ঐরকম করে ভেবেছি এবং অনেকবার বলেওছি— গোরা বলে যে, অতীতকে অতীত বলে বরখাস্ত করে বসে আছি বলেই কি সে অতীত ? বর্তমানের হাকডাকের আড়ালে পড়ে সে আমাদের দৃষ্টির অতীত হয়েছে বলেই অতীত নয়- সে ভারতবর্ষের মজার মধ্যে রয়েছে। কোনো সত্য কোনোদিনই অতীত হতে পারে না । সেইজন্যই ভারতবর্ষের এই সত্য আমাদের আঘাত করতে আরম্ভ করেছে। একদিন একে যদি আমাদের একজনও সত্য বলে চিনতে ও গ্রহণ করতে পারে তা হলেই আমাদের শক্তির খনির দ্বারে প্রবেশের পথ খুলে যাবেঅতীতের ভাণ্ডার বর্তমানের সামগ্ৰী হয়ে উঠবে। আপনি কি মনে করছেন ভারতবর্ষের কোথাও সেরকম সার্থকজন্মা লোকের আবির্ভাব হয় নি ?” সুচরিতা কহিল, “আপনি যেরকম করে এসব কথা বলছেন ঠিক সাধারণ লোকে এরকম করে বলে না- সেইজন্যে আপনাদের মতকে সমস্ত দেশের জিনিস বলে ধরে নিতে মনে সংশয় হয় ।” বিনয় কহিল, “দেখুন, সূর্যের উদয় ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিকেরা একরকম করে ব্যাখ্যা করে, আবার সাধারণ লোকে আর-এক রকম করে ব্যাখ্যা করে। তাতে সূর্যের উদয়ের বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি করে না । তবে কিনা সত্যকে ঠিকমত করে জানার দরুন আমাদের একটা লাভ আছে। দেশের যে-সকল সত্যকে আমরা খণ্ডিত করে বিক্ষিপ্ত করে দেখি গোরা তার সমস্তকে এক করে সংশ্লিষ্ট করে দেখতে পায়, গোরার সেই আশ্চর্য ক্ষমতা আছে- কিন্তু সেইজন্যই কি গোরার সেই দেখাকে দৃষ্টিবিভ্রম বলে মনে করবেন ? আর যারা ভেঙে চুরে দেখে তাদের দেখাটাই সত্য ?” সুচরিতা চুপ করিয়া রহিল। বিনয় কহিল, “আমাদের দেশে সাধারণত যে-সকল লোক নিজেকে পরম হিন্দু বলে অভিমান করে আমার বন্ধু গোরাকে আপনি সে দলের লোক বলে মনে করবেন না। আপনি যদি ওর বাপ কৃষ্ণদয়ালবাবুকে দেখতেন তা হলে বাপ ও ছেলের তফাত বুঝতে পারতেন। কৃষ্ণদয়ালবাবু সর্বদাই কাপড় ছেড়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে, পাজিপুঁথি মিলিয়ে নিজেকে সুপবিত্র করে রাখবার জন্যে অহরহ ব্যস্ত হয়ে আছেন— রান্না সম্বন্ধে খুব ভালো বামুনকেও তিনি বিশ্বাস করেন না, পাছে তার ব্ৰাহ্মণত্বে কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে- গোরাকে তঁর ঘরের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেন। না- কখনো যদি কাজের খাতিরে তার স্ত্রীর মহলে আসতে হয়, তা হলে ফিরে গিয়ে নিজেকে শোধন