পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 80. Σ সেটাতে বন্ধুত্বের সাম্য রক্ষিত হইত এবং বিনয় সাত্ত্বনা পাইত— কিন্তু গোরা যে গভীর হইয়া মস্ত বিচারক সাজিয়া মীেনার দ্বারা বিনয়কে অবজ্ঞা করিবে ইহাতে ললিতার কথার কাটা তাহাকে পুনঃপুনঃ বিধিতে লাগিল । এই সময় মহিম ইহঁকা হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন । ডিবা হইতে ভিজা ন্যাকড়ার আবরণ তুলিয়া একটা পান বিনয়ের হাতে দিয়া কহিলেন, “বাবা বিনয়, এ দিকে তো সমস্ত ঠিক— এখন কৃষ্ণ মুকুরের কাছ থেকে কখন উঠ গেলেই যে পশ্চিত হওয়া যায়। ঠাৱে বৃদ্ধ ঠি খছ তো ?” এই বিবাহের তাগিদ আজ বিনয়কে অত্যন্ত খারাপ লাগিল, অথচ সে জানিত মহিমের কোনো দোষ নাই- তাহাকে কথা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এই কথা দেওয়ার মধ্যে সে একটা দীনতা অনুভব করিল। আনন্দময়ী তো তাহাকে একপ্রকার বারণ করিয়াছিলেন- তাহার নিজেরও তো এ বিবাহের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না— তবে গোলেমালে ক্ষণকালের মধ্যেই এ কথাটা পাকিয়া উঠিল কী করিয়া ? গোরা যে ঠিক তাড়া লাগাইয়াছিল তাহা তো বলা যায় না। বিনয় যদি একটু মনের সঙ্গে আপত্তি করিত তাহা হইলেও যে গোরা পীড়াপীড়ি করিত তাহা নহে। কিন্তু তবু ! সেই তবুটুকুর উপরেই ললিতার খোচা আসিয়া বিধিতে লাগিল । সেদিনকার কোনো বিশেষ ঘটনা নহে, কিন্তু অনেক দিনের প্রভুত্ব ইহার পশ্চাতে আছে। বিনয় নিতান্তই কেবল ভালোবাসিয়া এবং একান্ত ভালোমানুষি-বশত গোরার আধিপত্য অনায়াসে সহ্য করিতে অভ্যস্ত হইয়াছে। সেইজন্যই এই প্রভুত্বের সম্বন্ধই বন্ধুত্বের মাথার উপর চড়িয়া বসিয়াছে। এতদিন বিনয় ইহা অনুভব করে নাই, কিন্তু আর তো ইহাকে অস্বীকার করিয়া চলে না। তবে শশিমুখীকে কি বিবাহ করিতেই হইবে ? বিনয় কহিল, “না, খুড়োমশায়কে এখনো চিঠি লেখা হয় নি।” মহিম কহিলেন, “ওটা আমারই ভুল হয়েছে। এ চিঠি তো তোমার লেখবার কথা নয়— ও আমিই লিখব। তার পুরো নামটা কী বলে তো বাবা।” বিনয় কহিল, “আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন ? আশ্বিন-কার্তিকে তো বিবাহ হতেই পারবে না | এক অম্লান মাস- কিন্তু তাতেও গোল আছে। আমাদের পরিবারের ইতিহাসে বহুপূর্বে আত্মান মাসে কবে কার কী দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অবধি আমাদের বংশে আঘানে বিবাহ প্রভৃতি সমস্ত শুভকর্ম বন্ধ আছে ।” মহিম ইকোটা ঘরের কোণের দেয়ালে ঠেস দিয়া রাখিয়া কহিলেন, “বিনয়, তোমরা যদি এ-সমস্ত মানবে তবে লেখাপড়া শেখাটা কি কেবল পড়া মুখস্থ করে মরা? একে তাে পােড়া দেশে শুভদিন খুঁজেই পাওয়া যায় না, তার পরে আবার ঘরে ঘরে প্রাইভেট পাজি খুলে বসলে কাজকর্ম চলবে কী করে ?” বিনয় কহিল, “আপনি ভাদ্র-আশ্বিন মাসই বা মানেন কেন ?” মহিম কহিলেন, “আমি মানি বুঝি ! কোনােকালেই না। কী করব বাবা- এ মুলুকে ভগবানকে না। মানলেও বেশ চলে যায়, কিন্তু ভাদ্র-আশ্বিন বৃহস্পতি-শনি তিথি-নক্ষত্র না মানলে যে কোনোমতে ঘরে টিকতে দেয় না। আবার তাও বলি- মানি নে বলছি বটে, কিন্তু কাজ করবার বেলা দিন-ক্ষণের অন্যথা হলেই মনটা অপ্ৰসন্ন হয়ে ওঠে— দেশের হাওয়ায় যেমন ম্যালেরিয়া হয় তেমনি ভয়ও হয়, ওটা কাটিয়ে উঠতে পারলুম না।” বিনয় । আমাদের বংশে অব্রানের ভয়টাও কাটবে না। অন্তত খুড়িমা কিছুতেই রাজি হবেন না। এমনি করিয়া সেদিনকার মতো বিনয় কোনোমতে কথাটা চাপা দিয়া রাখিল। বিনয়ের কথার সুর শুনিয়া গােরা বুঝিল, বিনয়ের মনে একটা দ্বিধা উপস্থিত হইয়াছে। কিছুদিন হইতে বিনয়ের দেখাই পাওয়া যাইতেছিল না। গোরা বুঝিয়াছিল বিনয় পরেশবাবুর বাড়ি পূর্বের চেয়েও আরো ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিয়াছে। তাহার পরে আজ এই বিবাহের প্রস্তাবে পাশ কাটাইবার চেষ্টায় গোরার মনে খটকা বাধিল ।