পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8\ტ\ტ রবীন্দ্র-রচনাবলী করাইবার জন্য তাহার একটা রোখি জন্মিয়ছিল। বিনয় যে গোরার অনুবতী। ইহা ললিতার কাছে কেন এত অসহ্য হইয়াছিল তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিতেছিল না। যেমন করিয়া হােক সমস্ত বন্ধন কাটিয়া বিনয়কে স্বাধীন করিয়া দিতে পারিলে সে যেন বঁাচে, এমনি হইয়া উঠিয়াছে। । ললিতা তাহার বেণী দুলাইয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, “কেন মশায়, অভিনয়ে দোষটা কী ?” বিনয় কহিল, “অভিনয়ে দোষ না থাকতে পারে, কিন্তু ঐ ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়িতে অভিনয় করতে যাওয়া আমার মনে ভালো লাগছে না ।” ললিতা । আপনি নিজের মনের কথা বলছেন, না। আর কারও ? বিনয় । অন্যের মনের কথা বলবার ভার আমার উপরে নেই, বলাও শক্ত । আপনি হয়তো বিশ্বাস কুল্লা আমি নেিজর মেনর কথাটাই বলে থাকি-কালে নেিজর জবানিতে কখনাে বা অন্যে ললিতা এ কথার কোনো জবাব না দিয়া একটুখানি মুচকিয়া হাসিল মাত্র। একটু পরে কহিল, “আপনার বন্ধু গীেরবাবু বোধ হয় মনে করেন ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করলেই খুব একটা বীরত্ব হয়, ওতেই ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করার ফল হয় ।” করি। লড়াই নয় তো কী ? যে লোক আমাকে গ্রাহাই করে না, মনে করে আমাকে কড়ে আঙুল তুলে ইশারায় ডাক দিলেই আমি কৃতাৰ্থ হয়ে যােব, তার সেই উপেক্ষার সঙ্গে উপেক্ষা দিয়েই যদি লড়াই না। করি তা হলে আত্মসম্মানকে বাচােব কী করে ?” ললিতা নিজে অভিমানী স্বভাবের লোক, বিনয়ের মুখের এই অভিমানবাক্য তাহার ভালোই লাগিল। কিন্তু সেইজন্যই তাহার নিজের পক্ষের যুক্তিকে দুর্বল অনুভব করিয়াই ললিতা অকারণ বিদ্যুপের খোচায় বিনয়কে কথায় কথায় আহত করিতে লাগিল। শেষকালে বিনয় কহিল, “দেখুন, আপনি তর্ক করছেন কেন ? আপনি বলুন-না কেন, “আমার ইচ্ছা, আপনি অভিনয়ে যোগ দেন।' তা হলে আমি আপনার অনুরোধরক্ষার খাতিরে নিজের মতটাকে বিসর্জন দিয়ে একটা সুখ পাই ।” ললিত কহিল, “বাঃ, তা আমি কেন বলব ? সত্যি যদি আপনার কোনো মত থাকে তা হলে সেটা আমার অনুরোধে কেন ত্যাগ করতে যাবেন ? কিন্তু সেটা সত্যি হওয়া চাই।” বিনয় কহিল, “আচ্ছা, সেই কথাই ভালো । আমার সত্যিকার কোনো মত নেই। আপনার অনুরোধে নাই হল, আপনার তর্কেই পরাস্ত হয়ে আমি অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হলুম।” এমন সময় বরদাসুন্দরী ঘরে প্রবেশ করিবামােত্রই বিনয় উঠিয়া গিয়া তঁহাকে কহিল, “অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হলে আমাকে কী করতে হবে বলে দেবেন।” বরদাসুন্দরী সগর্বে কহিলেন, “সেজন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমরা আপনাকে ঠিক তৈরি করে নিতে পারব । কেবল অভ্যাসের জন্য রোজ। আপনাকে নিয়মিত আসতে হবে ।” বিনয় কহিল, “আচ্ছা। আজ তবে আসি ।” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে কী কথা ? আপনাকে খেয়ে যেতে হচ্ছে।” বিনয় কহিল, “আজ নাই খেলুম।” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, সে হবে না।” বিনয় খাইল, কিন্তু অন্য দিনের মতো তাহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা ছিল না। আজ সুচরিতাও কেমন অন্যমনস্ক হইয়া চুপ করিয়া ছিল। যখন ললিতার সঙ্গে বিনয়ের লড়াই চলিতেছিল তখন সে বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছিল। আজ রাত্রে কথাবার্তা আর জমিল না। বিদায়ের সময় বিনয় ললিতার গষ্ঠীর মুখ লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আমি হার মানলুম, তবু আপনাকে খুশি করতে পারলুম না।” ললিতা কোনাে জবাব না দিয়া চলিয়া গেল।