পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

By রবীন্দ্র-রচনাবলী সে তাহার বন্ধুঝণ শোধ করিবার জন্য চলিল । রাস্তায় বিনয়ের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। ‘বিনয়বাবু বিনয়বাবু করিয়া দূর হইতে র্তাহাকে ডাক দিয়া সতীশ তাহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং জামার মধ্যে ফুল লুকাইয়া কহিল, “আপনার জন্যে কী এনেছি বলুন দেখি ।” বিনয়কে হার মানাইয়া গোলাপ ফুল দুইটি বাহির করিল। বিনয় কহিল, “বাঃ, কী চমৎকার! কিন্তু সতীশবাবু, এটিতো তোমার নিজের জিনিস নয়। চোরাই মাল নিয়ে শেষকালে পুলিসের হাতে পড়ব . R (VO ?ʼ এই ফুল দুটিকে ঠিক নিজের জিনিস বলা যায় কি না, সে সম্বন্ধে সতীশের হঠাৎ ধোক লাগিল। সে একটু ভাবিয়া কহিল, “না, বাঃ, ললিতাদিদি আমাকে দিলেন যে আপনাকে দিতে। ” এই কথাটার এইখানেই নিম্পত্তি হইল এবং বিকালে তাহদের বাড়ি যাইবে বলিয়া আশ্বাস দিয়া বিনয় সতীশকে বিদায় দিল । কাল রাত্রে ললিতার কথার খোচা খাইয়া বিনয় তাহার বেদনা ভুলিতে পারিতেছিল না। বিনয়ের সঙ্গে কাহারও প্রায় বিরোধ হয় না । সেইজন্য এইপ্ৰকার তীব্র আঘাত সে কাহারও কাছে প্ৰত্যাশাই করে না। ইতিপূর্বে ললিতাকে বিনয় সুচরিতার পশ্চাদবর্তিনী করিয়াই দেখিয়ছিল। কিন্তু অঙ্কুশাহত হাতি যেমন তাহার মাহুতকে ভুলিবার সময় পায় না, কিছুদিন হইতে ললিতা সম্বন্ধে বিনয়ের সেই দশা হইয়াছিল। কী করিয়া ললিতাকে একটুখানি প্ৰসন্ন করিবে এবং শান্তি পাইবে বিনয়ের এই চিন্তাই প্রধান হইয়া উঠিয়ছিল। সন্ধ্যার সময় বাসায় আসিয়া ললিতার তীব্ৰহাস্যদিগ্ধ জ্বালাময় কথাগুলি একটার পর একটা কেবলই তাহার মনে বাজিয়া উঠিত এবং তাহার নিদ্ৰা দূর করিয়া রাখিত । “আমি গোরার ছায়ার মতো, আমার নিজের কোনো পদার্থ নাই, ললিতা এই বলিয়া অবজ্ঞা করেন, কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ অসত্য।’ ইহার বিরুদ্ধে নানাপ্রকার যুক্তি সে মনের মধ্যে জড়ো করিয়া তুলিত। কিন্তু এ-সমস্ত যুক্তি তাহার কোনো কাজে লাগিত না । কারণ, ললিতা তো স্পষ্ট করিয়া এ অভিযোগ তাহার বিরুদ্ধে আনে নাই— এ কথা লইয়া তর্ক করিবার অবকাশই তাহাকে দেয় নাই। বিনয়ের জবাব দিবার এত কথা ছিল, তবু সেগুলা ব্যবহার করিতে না পারিয়া তাহার মনে ক্ষোভ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে কাল রাত্রে হরিয়াও যখন ললিতার মুখ সে প্রসন্ন দেখিল না। তখন বাড়িতে আসিয়া সে নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল । মনে মনে ভাবিতে লাগিল, সত্যই কি আমি এতই অবজ্ঞার পাত্র ? এইজন্যই সতীশের কাছে যখন সে শুনিল যে, ললিতাই তাহাকে গোলাপ ফুল দুটি সতীশের হাত দিয়া পঠাইয়া দিয়াছে তখন সে অত্যন্ত একটা উল্লাস বোধ করিল। সে ভাবিল, অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হওয়াতেই সন্ধির নিদর্শনস্বরূপ ললিতা তাহাকে খুশি হইয়া এই গোলাপ দুটি দিয়াছে। প্রথমে মনে করিল “ফুল দুটি বাড়িতে রাখিয়া আসি ; তাহার পরে ভাবিল, “না, এই শান্তির ফুল মায়ের পায়ে দিয়া ইহাকে পবিত্ৰ করিয়া আনি ।” সেদিন বিকালে বিনয় যখন পরেশবাবুর বাড়িতে গেল তখন সতীশ ললিতার কাছে তাহার ইস্কুলের స్టోశా । বিনয় ললিতাকে কহিল, “যুদ্ধেরই রঙ লাল, অতএব সন্ধির ফুল সাদা হওয়া " ললিতা কথাটা বুঝিতে না পারিয়া বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল। বিনয় তখন একটি গুচ্ছ শ্বেতকরবী চাদরের মধ্য হইতে বাহির করিয়া ললিতার সম্মুখে ধরিয়া কহিল, “আপনার ফুল দুটি যতই সুন্দর হােক, তবু তাতে ক্রোধের রঙটুকু আছে। আমার এ ফুল সৌন্দর্যে তার কাছে দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু শান্তির শুভ্র রঙের নম্রতা স্বীকার করে আপনার কাছে হাজির হয়েছে।” ললিতা কর্ণমূল রাঙা করিয়া কহিল, “আমার ফুল আপনি কাকে বলছেন ?” বিনয় কিছু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “তবে তো ভুল বুঝেছি। সতীশবাবু, কার ফুল কাকে দিলে ?” সতীশ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “বাঃ, ললিতাদিদি যে দিতে বললে!”