পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Գեր রবীন্দ্র-রচনাবলী একটা আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, যাতে সাংসারিক দায়িত্ব নেই। অথচ বন্ধন আছে- এটা বিশেষ উপকারী ।” হারানবাবু কহিলেন, “তিনি তো পূর্বেই মত দিয়েছেন।” সুচরিতাকে ডাকিয়া তাহার নিকট হারানবাবুর প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। সুচরিতা নিজের দ্বিধাগ্ৰস্ত জীবনকে একটা কোথাও চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করিতে পারিলে বীচে— তাই সে এমন অবিলম্বে এবং নিশ্চিতভাবে সম্মতি দিল যে পরেশবাবুর সমস্ত সন্দেহ দূর হইয়া গেল। বিবাহের এত পূর্বে আবদ্ধ হওয়া কর্তব্য কি না তাহা তিনি ভালোরূপ বিবেচনা করিবার জন্য সুচরিতাকে অনুরোধ করিলেনতৎসত্ত্বেও সুচরিতা এ প্রস্তাবে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না ! সম্বন্ধ পাকা করা হইবে এইরূপ স্থির হইল । ሎ সুচরিতার ক্ষণকালের জন্য মনে হইল তাহার মন যেন রাহুর গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়াছে। সে মনে মনে স্থির করিল, হারানবাবুকে বিবাহ করিয়া ব্ৰাহ্মসমাজের কাজে যোগ দিবার জন্য সে মনকে কঠোরভাবে প্রস্তুত করিবে । হারানবাবুর নিকট হইতেই সে প্রত্যহ খানিকটা করিয়া ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে ইংরেজি বই পড়িয়া তাহারই নির্দেশমত চলিতে থাকিবে এইরূপ সংকল্প করিল। তাহার পক্ষে যাহা দুরূহ, এমন-কি অপ্রিয়, তাহাই গ্রহণ করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া সে মনের মধ্যে খুব একটা স্ফীতি অনুভব করিল। হারানবাবুর সম্পাদিত ইংরেজি কাগজ কিছুকাল ধরিয়া সে পড়ে নাই। আজ সেই কাগজ ছাপা হইবামাত্র তাহা হাতে আসিয়া পড়িল । বোধ করি হারানবাবু বিশেষ করিয়াই পঠাইয়া দিয়াছেন । সুচরিতা কাগজখানি ঘরে লইয়া গিয়া স্থির হইয়া বসিয়া পরম কর্তব্যের মতো তাহার প্রথম লাইন হইতে পড়িতে আরম্ভ করিল। শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে নিজেকে ছাত্রীর মতো জ্ঞান করিয়া এই পত্রিকা হইতে উপদেশ’ গ্ৰহণ করিতে লাগিল । জাহাজ পালে চলিতে চলিতে হঠাৎ পাহাড়ে ঠেকিয়া কত হইয়া পড়িল । এই সংখ্যায় ‘সেকেলে বায়ুগ্ৰস্ত’-নামক একটি প্রবন্ধ আছে, তাহাতে বর্তমান কালের মধ্যে বাস করিয়াও যাহারা সেকালের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে তাহাদিগকে আক্রমণ করা হইয়াছে। যুক্তিগুলি যে অসংগত তাহা নহে, বস্তুত এরূপ যুক্তি সুচরিতা সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু প্ৰবন্ধটি পড়বা মাত্রই সে বুঝিতে পারিল যে এই আক্রমণের লক্ষ্য গোরা । অথচ তাহার নাম নাই, অথবা তাহার লিখিত কোনো প্রবন্ধের উল্লেখ নাই । বন্দুকের প্রত্যেক গুলির দ্বারা একটা করিয়া মানুষ মারিয়া সৈনিক যেমন খুশি হয় এই প্রবন্ধের প্রত্যেক বাক্যে তেমনি কোনো-একটি সজীব পদার্থ বিদ্ধ হইতেছে বলিয়া যেন একটা হিংসার আনন্দ ব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে। এই প্রবন্ধ সুচরিতার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল। ইহার প্রত্যেক যুক্তি প্রতিবাদের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে তাহার ইচ্ছা হইল। সে মনে মনে কহিল, গৌরমোহনবাবু যদি ইচ্ছা করেন তবে এই প্ৰবন্ধকে তিনি ধুলায় লুটাইয়া দিতে পারেন। গোরার উজ্জ্বল মুখ তাহার চােখের সামনে জ্যোতির্ময় হইয়া জাগিয়া উঠিল এবং তাহার প্রবল কণ্ঠস্বর সুচরিতার বুকের ভিতর পর্যন্ত ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সেই মুখের ও বাক্যের অসামান্যতার কাছে এই প্রবন্ধ ও প্রবন্ধলেখকের ক্ষুদ্রতা এমনই তুচ্ছ হইয়া উঠিল যে সুচরিতা কুগিজখানাকে মাটিতে ফুেলিয়া দিল। অনেক কাল পরে সুচরিতা আপনি সেদিন বিনয়ের কাছে আসিয়া বসিল এবং তাঁহাকে কথায় কথায় বলিল, “আচ্ছা, আপনি যে বলেছিলেন যে-সব কাগজে আপনাদের লেখা বেরিয়েছে আমাকে পড়তে এনে দেবেন, কই দিলেন না ?” বিনয় এ কথা বলিল না যে ইতিমধ্যে সুচরিতার ভাবান্তর দেখিয়া সে আপন প্রতিশ্রুতি পালন করিতে সাহস করে নাই- সে কহিল, “আমি সেগুলো একত্র সংগ্রহ করে রেখেছি, কালই এনে দেব ।” ।