পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(53. 8brዔ গোরা কহিল, “ভ্ৰমণ করতে করতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলুম। পুলিসের অত্যাচারে গ্রামের দুৰ্গতির চিহ্ন দেখে এবং আরো উপদ্রবের সম্ভাবনা আছে জেনে প্রতিকারের জন্য আপনার কাছে এসেছি।” ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন, “চর-ঘোষপুরের লোকগুলো অত্যন্ত বদমায়েস সে কথা তুমি জান ?” গোরা কহিল, “তারা বদমায়েস নয়, তারা নিৰ্ভীক, স্বাধীনচেতা- তারা অন্যায় অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে পারে না।” মজিষ্ট্রেট চটিয়া উঠিলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করিলেন নব্যবাঙালি ইতিহাসের পুঁথি পড়িয়া কতকগুলা বুলি শিখিয়াছে— ইনসাফারেবল ! “এখানকার অবস্থা তুমি কিছুই জান না” বলিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট গোরাকে খুব একটা ধমক দিলেন। “আপনি এখানকার অবস্থা আমার চেয়ে অনেক কম জানেন।” গোরা মেঘমন্দ্রস্বরে জবাব করিল। ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন, “আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। তুমি যদি ঘোষপুরের ব্যাপার সম্বন্ধে কোনােপ্রকার হস্তক্ষেপ কর তা হলে খুব সস্তায় নিস্কৃতি পাবে না।” গোরা কহিল, “আপনি যখন অত্যাচারের প্রতিবিধান করবেন না বলে মনস্থির করেছেন এবং গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে আপনার ধারণা যখন বদ্ধমূল, তখন আমার আর-কোনাে উপায় নেই— আমি গ্রামের লোকদের নিজের চেষ্টায় পুলিসের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্যে উৎসাহিত করব।” ম্যাজিষ্ট্রেট চলিতে চলিতে হঠাৎ থামিয়া দাড়াইয়া বিদ্যুতের মতো গোরার দিকে ফিরিয়া গৰ্জিয়া উঠলেন, “কী ! এত বড়ো স্পর্ধা !” গোরা দ্বিতীয় কোনো কথা না বলিয়া ধীরগমনে চলিয়া গেল । ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন, "হারানবাবু, আপনাদের দেশের লোকদের মধ্যে এ-সকল কিসের লক্ষণ দেখা যাইতেছে ?” হারানবাবু কহিলেন, “ লেখাপড়া তেমন গভীরভাবে হইতেছে না, বিশেষত দেশে আধ্যাত্মিক ও চরিত্রনৈতিক শিক্ষা একেবারে নাই বলিয়াই এরূপ ঘটিতেছে। ইংরেজি বিদ্যার যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা গ্রহণ করিবার অধিকার ইহাদের হয় নাই। ভারতবর্ষে ইংরেজের রাজত্ব যে ঈশ্বরের বিধান— এই অকৃতজ্ঞরা এখনো তাহা স্বীকার করিতে চাহিতেছে না। তাহার একমাত্র কারণ, ইহারা কেবল পড়া মুখস্থ করিয়াছে, কিন্তু ইহাদের ধর্মবোধ নিতান্তই অপরিণত ।” সুন্টু বলেন, “প্ষ্টর স্বীকার বা করলে ভারতবরে ঐ করেন তখনই পৃষ্ঠা লাভ রবে না ।” । হারানবাবু কহিলেন, “সে এক হিসাবে সত্য।” এই বলিয়া খৃস্টকে স্বীকার করা সম্বন্ধে একজন খৃস্টানের সঙ্গে হারানবাবুর মতের কোন অংশে কতটুকু ঐক্য এবং কোথায় অনৈক্য তাহাই লইয়া হারানবাবু ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত সূক্ষ্মভাবে আলাপ করিয়া তীহাকে এই কথাপ্রসঙ্গে এতই নিবিষ্ট করিয়া রাখিয়ছিলেন যে, মেমসাহেব যখন পরেশবাবুর মেয়েদিগকে গাড়ি করিয়া ডাকবাংলায় পীেছাইয়া দিয়া ফিরিবার পথে তাহার স্বামীকে কহিলেন, “হ্যারি, ঘরে ফিরিতে হইবে”, তিনি চমকিয়া উঠিয়া ঘড়ি থুলিয়া কহিলেন, “বাই জোভ, আটটা বাজিয়া কুড়ি মিনিট ।” গাড়িতে উঠিবার সময় হারানবাবুর কর নিপীড়ন করিয়া বিদায়সম্ভাষণপূর্বক কহিলেন, “আপনার সহিত আলাপ করিয়া আমার সন্ধ্যা খুব সুখে কাটিয়াছে।” হারানবাবু ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত র্তাহার আলাপের বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। কিন্তু গোরার সহিত সাক্ষাতের কোনো উল্লেখমাত্র করিলেন না।