পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8述)の রবীন্দ্র-রচনাবলী সূক্ষ্ম আইন করতে হয়, সূক্ষ্ম আইন করতে গেলেই আইনের ব্যবসায়ী না হলে কাজ চলেই না, ব্যাবসা চালাতে গেলেই কেনাবেচা এসে পড়ে— অতএব সভ্যতার আদালত আপনিই বিচার-কেনাবেচার হাট হয়ে উঠবেই।- যার টাকা নেই তার ঠকবার সম্ভাবনা থাকবেই। তুমি রাজা হলে কী করতে বলে। দেখি ।” গোরা কহিল, “যদি এমন আইন করতুম যে হাজার দেড়-হাজার টাকা বেতনের বিচারকের বুদ্ধিতেও তার রহস্য ভেদ হওয়া সম্ভব হত না, তা হলে হতভাগা বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষের জন্য উকিল সরকারি খরচে নিযুক্ত করে দিতুম । বিচার ভালো হওয়ার খরচা প্রজার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সুবিচারের গৌরব করে পাঠান-মোগলদের গাল দিতুম না।” সাতকড়ি কহিল, “বেশ কথা, সে শুভদিন যখন আসে নি—তুমি যখন রাজা হও নি— সম্প্রতি তুমি যখন সভ্য রাজার আদালতের আসামি— তখন তোমাকে হয় গীটের কড়ি খরচ করতে হবে নয় উকিল-বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হবে, নয় তো তৃতীয় গতিটা সদগতি হবে না।” গোরা জেদ করিয়া কহিল, “কোনো চেষ্টা না করে যে গতি হতে পারে আমার সেই গতিই হােক । এ রাজ্যে সম্পূর্ণ নিরুপায়ের যে গতি, আমারও সেই গতি ।” বিনয় অনেক অনুনয় করিল, “কিন্তু গোরা তাহাতে কৰ্ণপাতমাত্র করিল না। সে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি হঠাৎ এখানে কী করে উপস্থিত হলে ?” বিনয়ের মুখ ঈষৎ রক্তাভ হইয়া উঠিল। গোরা যদি আজ হাজতে না থাকিত তবে বিনয় হয়তো কিছু বিদ্রোহের স্বরেই তাহার এখানে উপস্থিতির কারণটা বলিয়া দিত। আজ স্পষ্ট উত্তরটা তাহার মুখে বাধিয়া গেল ; কহিল, “আমার কথা পরে হবে- এখন তোমার--” গোরা কহিল, “আমি তো আজ রাজার অতিথি । আমার জন্যে রাজা স্বয়ং ভাবছেন, তোমাদের আর কারও ভাবতে হবে না ।” ܀- বিনয় জানিত গোরাকে টলানো সম্ভব নয়- অতএব উকিল রাখার চেষ্টা ছাড়িয়া দিতে হইল । বলিল, “তুমি তো খেতে এখানে পারবে না জানি, বাইরে থেকে কিছু খাবার পাঠাবার জোগাড় করে ईि ।” গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনয়, কেন তুমি বৃথা চেষ্টা করছি। বাইরে থেকে আমি কিছুই চাই নে। হাজতে সকলের ভাগ্যে যা জোটে আমি তার চেয়ে কিছু বেশি চাই নে ৷” বিনয় ব্যথিত চিত্তে ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিল । সুচরিতা রাস্তার দিকের একটা শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া জানিলা খুলিয়া বিনয়ের প্রত্যাবর্তন প্রতীক্ষা করিয়া ছিল । কোনোমতেই অন্য সকলের সঙ্গ এবং আলাপ সে সহ্য করিতে পারিতেছিল না। সুচরিতা যখন দেখিল বিনয় চিন্তিত বিমর্ষমুখে ডাকবাংলার অভিমুখে আসিতেছে তখন আশঙ্কায় তাহার বুকের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল। বহু চেষ্টায় সে নিজেকে শান্ত করিয়া একটা বই হাতে করিয়া বসিবার ঘরে আসিল। ললিতা সেলাই ভালোবাসে না, কিন্তু সে আজ চুপ করিয়া কোণে বসিয়া সেলাই করিতেছিল— লাবণ্য সুধীরকে লইয়া ইংরেজি বানানের খেলা খেলিতেছিল, লীলা ছিল দর্শক ; হারানবাবু বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আগামী কল্যকার উৎসবের কথা আলোচনা করিতেছিলেন । আজ প্ৰাতঃকালে পুলিসের সঙ্গে গোরার বিরোধের ইতিহাস বিনয় সমস্ত বিবৃত করিয়া বলিল । কুল্ল আৰু ইয়া বসিয়া বলি, ললিতার কোল হইতে সেলাই পড়িয়া গেল এবং মুখ লাল হইয়া বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আপনি কিছু ভাববেন না বিনয়বাবু— আজি সন্ধ্যাবেলায় ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের মেমের কাছে গৌরমোহনবাবুর জন্যে আমি নিজে অনুরোধ করব।” বিনয় কহিল, “না, আপনি তা করবেন না- গোরা যদি শুনতে পায় তা হলে জীবনে সে আমাকে আর ক্ষমা করবে না ।” সুধীর কহিল, “র্তার ডিফেন্সের জন্যে তো কোনো বন্দােবস্ত করতে হবে।”