পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ >8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সে বিছানায় শুইতে যায়, তখন সে নিজের মনখানা লইয়া কী যে করিবে ভাবিয়া পায় না । বুক ফাটিয়া কান্না আসে- সঙ্গে সঙ্গে রাগ হইতে থাকে, কাহার উপরে রাগ বুঝিয়া উঠাই শক্ত । রাগ বুঝি নিজের উপরেই। কেবলই মনে হয়, “এ কী হইল ! আমি বাচিব কী করিয়া ! কোনো দিকে তাকাইয়া যে কোনো রাস্তা দেখিতে পাই না । এমন করিয়া কতদিন চলিবে ।” ললিতা জানে, বিনয় হিন্দু, কোনোমতেই বিনয়ের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতে পারে না। অথচ নিজের হৃদয়কে কোনোমতেই বশ মানাইতে না পারিয়া লজায় ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেছে। বিনয়ের হৃদয় যে তাহার প্রতি বিমুখ নহে। এ কথা সে বুঝিয়াছে ; বুঝিয়াছে বলিয়াই নিজেকে সংবরণ করা তাহার পক্ষে আজ এত কঠিন হইয়াছে। সেইজন্যই সে যখন উতলা হইয়া বিনয়ের আশপথ চাহিয়া থাকে সেইসঙ্গেই তাহার মনের ভিতরে একটা ভয় হইতে থাকে, পাছে বিনয় আসিয়া পড়ে। এমনি করিয়া নিজের সঙ্গে টানাটানি করিতে করিতে আজ সকালে তাহার ধৈর্য আর বঁাধ মানিল না । তাহার মনে হইল, বিনয় না। আসাতেই তাহার প্রাণের ভিতরটা কেবলই অশান্ত হইয়া উঠিতেছে, একবার দেখা হইলেই এই অস্থিরতা দূর হইয়া যাইবে । সকালবেলা সে সতীশকে নিজের ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল । সতীশ আজকাল মাসিকে পাইয়া বিনয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বচর্চার কথা একরকম ভুলিয়াই ছিল। ললিতা তাহাকে কহিল, “বিনয়বাবুর সঙ্গে তোর বুঝি ঝগড়া হয়ে গেছে ?” সে এই অপবাদ সতেজে অস্বীকার করিল। ললিত কহিল, “ভারি তো তোর বন্ধু ! তুইই কেবল সতীশ কহিল, “ইস ! তাই তো ! ককখনো না !” পরিবারের মধ্যে ক্ষুদ্রতম সতীশকে নিজের গৌরব সপ্রমাণ করিবার জন্য এমনি করিয়া বারংবার গলার জোর প্রয়োগ করিতে হয় । আজ প্রমাণকে তাহার চেয়েও দৃঢ়তর করিবার জন্য সে তখনই বিনয়ের বাসায় ছুটিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “তিনি যে বাড়িতে নেই, তাই জন্যে আসতে পারেন নি ।” ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “এ কদিন আসেন নি কেন ?” সতীশ কহিল, “কদিনই যে ছিলেন না ।” একবার যাওয়া উচিত ।” সুচরিতা কহিল, “তাদের সঙ্গে যে পরিচয় নেই।” ললিতা কহিল, “বাঃ, গীেরবাবুর বাপ যে বাবার ছেলেবেলাকার বন্ধু ছিলেন ।” সুচরিতার মনে পড়িয়া গেল, কহিল, “হা, তা বটে ।” সুচরিতাও অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিল । কহিল, “ললিতভাই, তুমি যাও, বাবার কাছে বলে। (if " ললিত কহিল, “না, আমি বলতে পারব না, তুমি বলে গে।” শেষকালে সুচরিতাই পরেশবাবুর কাছে গিয়া কথাটা পাড়িতেই তিনি বলিলেন, “ঠিক বটে, এতদিন আমাদের যাওয়া উচিত ছিল |” আহারের পর যাওয়ার কথাটা যখনই স্থির হইয়া গেল তখনই ললিতার মন বাকিয়া উঠিল । তখন আবার কোথা হইতে অভিমান এবং সংশয় আসিয়া তাহাকে উলটা দিকে টানিতে লাগিল। সুচরিতাকে গিয়া সে কহিল, “দিদি, তুমি বাবার সঙ্গে যাও । আমি যাব না।” সুচরিতা কহিল, “সে কি হয় ! তুই না গেলে আমি একলা যেতে পারব না। লক্ষ্মী আমার, ভাই আমার- চল ভাই, গোল করিস নে ৷” অনেক অনুনয়ে ললিতা গেল। কিন্তু বিনয়ের কাছে সে যে পরাস্ত হইয়াছে- বিনয় অনায়াসেই তাহাদের বাড়ি না আসিয়া পারিল, আর সে আজ বিনয়কে দেখিতে ছুটিয়াছে— এই পরাভাবের