পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Q)● VOA সুচরিতার মাসি হরিমোহিনীকে লইয়া পরেশের পরিবারে একটা গুরুতর অশান্তি উপস্থিত হইল। তাহা বিবৃত করিয়া বলিবার পূর্বে, হরিমোহিনী সুচরিতার কাছে নিজের যে পরিচয় দিয়াছিলেন তাঁহাই সংক্ষেপ করিয়া নীচে লেখা গেল আমি তোমার মায়ের চেয়ে দুই বছরের বড়ো ছিলাম। বাপের বাড়িতে আমাদের দুইজনের আদরের সীমা ছিল না। কেননা, তখন আমাদের ঘরে কেবল আমরা দুই কন্যাই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম- বাড়িতে আর শিশু কেহ ছিল না। কাকাদের আদরে আমাদের মাটিতে পা ফেলিবার অবকাশ ঘটিত না । আমার বয়স যখন আট তখন পালসার বিখ্যাত রায়চৌধুরীদের ঘরে আমার বিবাহ হয়। র্তাহারা কুলেও যেমন ধনেও তেমন । কিন্তু আমার ভাগ্যে সুখ ঘটিল না। বিবাহের সময় খরচ-পত্ৰ লইয়া আমার শ্বশুরের সঙ্গে পিতার বিবাদ বাধিয়াছিল। আমার পিতৃগৃহের সেই অপরাধ আমার শ্বশুরবংশ অনেক দিন পর্যন্ত ক্ষমা করিতে পারেন নাই | সকলেই বলিতআমাদের ছেলের আবার বিয়ে দেব, দেখি ও মেয়েটার কী দশা হয়। আমার দুর্দশা দেখিয়াই বাবা প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, কখনো ধনীর ঘরে মেয়ে দিবেন না । তাই তোমার মাকে গরিবের ঘরেই দিয়াছিলেন । বহু পরিবারের ঘর ছিল, আমাকে আট-নয় বৎসর বয়সের সময়েই রান্না করিতে হইত । প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক খাইত | সকলের পরিবেশনের পরে কোনোদিন শুধু ভাত, কোনোদিন বা ডালভাত খাইয়াই কাটাইতে হইত। কোনোদিন বেলা দুইটার সময়ে, কোনোদিন বা একেবারে বেলা গেলে আহার করিতাম। আহার করিয়াই বৈকালের রান্না চড়াইতে যাইতে হইত। রাত এগারোটা বারোটার সময় খাইবার অবকাশ ঘটিত । শুইবার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। অন্তঃপুরে যাহার সঙ্গে যেদিন সুবিধা হইত। তাহার সঙ্গেই শুইয়া পড়িতাম । কোনোদিন বা পিঁড়ি পাতিয়া নিদ্ৰা দিতে হইত। বাড়িতে আমার প্রতি সকলের যে অনাদর ছিল আমার স্বামীর মনও তাঁহাতে বিকৃত না হইয়া থাকিতে পারে নাই। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি আমাকে দূরে দূরেই রাখি, ছিলেন। এমন সময়ে আমার বয়স যখন সতেরো তখন আমার কন্যা মনোরমা জন্মগ্রহণ করে । মেয়েকে জন্ম দেওয়াতে শ্বশুরকুলে আমার গঞ্জনা আরো বাড়িয়া গিয়াছিল। আমার সকল অনাদর সকল লাঞ্ছনার মধ্যে এই মেয়েটিই আমার একমাত্র সাস্তুনা ও আনন্দ ছিল। মনোরমাকে তাহার বাপ এবং আর কেহ তেমন করিয়া আদর করে নাই বলিয়াই সে আমার প্ৰাণপণ আদরের সামগ্ৰী হইয়া উঠিয়াছিল। তিন বৎসর পরে যখন আমার একটি ছেলে হইল। তখন হইতে আমার অবস্থার পরিবর্তন হইতে লাগিল। তখন আমি বাড়ির গৃহিণী বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য হইলাম। আমার শাশুড়ি ছিলেন না— আমার শ্বশুরও মনোরমা জন্মিবার দুই বৎসর পরেই মারা যান। তাহার মৃত্যুর পরেই বিষয় লইয়া দেবীরদের সঙ্গে মকদ্দমা বাধিয়া গেল। অবশেষে মামলায় অনেক সম্পত্তি নষ্ট করিয়া আমরা পৃথক হইলাম। মনোরমার বিবাহের সময় আসিল। পাছে তাহাকে দূরে লইয়া যায়, পাছে তাহাকে আর দেখিতে না নাই, এই ভয়ে পালসা হইতে পাঁচ-ছয় ক্রোশ তফাতে সিমুলে গ্রামে তাহার বিবাহ দিলাম। ছেলেটিকে কার্তিকের মতো দেখিতে। যেমন রঙ, তেমনি চেহারা— খাওয়াপরার সংগতিও তাঁহাদের ছিল । একদিন আমার যেমন অনাদর ও কষ্ট গিয়াছে, কপাল ভাঙিবার পূর্বে বিধাতা কিছুদিনের জন্য আমাকে তেমনি সুখ দিয়াছিলেন। শেষাশেষি আমার স্বামী আমাকে বড়োই আদর ও