পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ( δ δ বাধাও আর সে মানিল না। টাকার জন্য মনোরমার সামনেই আমার প্রতি উপদ্রব করিতে লাগিল। মনোরম জেদ করিয়া বলিত— কোনোমতেই টাকা দিতে পরিবে না। কিন্তু আমার বড়ো দুর্বল মন, পাছে জামাই আমার মেয়ের উপর অত্যন্ত বেশি বিরক্ত হইয়া উঠে এই ভয়ে আমি তাহাকে কিছু না দিয়া থাকিতে পারিতাম না। মনোরমা একদিন বলিল, মা, তোমার টাকাকড়ি সমস্ত আমিই রাখিব । বলিয়া আমার চাবি ও বাক্স সব দখল করিয়া বসিল । জামাই আসিয়া যখন আমার কাছে আর টাকা পাইবার সুবিধা দেখিল না এবং যখন মনােরমাকে কিছুতেই নরম করিতে পারিল না, তখন সুর ধরিলমেজেবিউকে বাড়িতে লইয়া যাইব । আমি মনােরমাকে বলিতাম, দে মা, ওকে কিছু টাকা দিয়েই বিদায় করে দে— নইলে ও কী করে বসে কে জানে। কিন্তু আমার মনোরমা এক দিকে যেমন নরম আর-এক দিকে তেমনি শক্ত ছিল । সে বলিত, না, টাকা কোনোমতেই দেওয়া হবে না । জামাই একদিন আসিয়া চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল, কাল আমি বিকালবেলা পালকি পাঠিয়ে দেব । বউকে যদি ছেড়ে না দাও। তবে ভালো হবে না, বলে রাখছি। পরদিন সন্ধ্যার পূর্বে পালকি আসিলে আমি মনােরমাকে বলিলাম, মা, আর দেরি করে কাজ নেই, আবার আসছে হপ্তায় তোমাকে আনবার জন্য লোক পাঠাব। মনােরমা কহিল, আজ থাক, আজ আমার যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মা, আর দুদিন বাদে আসতে বলো । আমি বলিলাম, মা, পালকি ফিরিয়ে দিলে কি আমার খেপা জামাই রক্ষা রাখবে ? কাজ নেই, মনু, তুমি আজই যাও । মনু বলিল, না, মা, আজ নয়— আমার শ্বশুর কলিকাতায় গিয়েছেন, ফায়ুনের মাঝামাঝি তিনি ফিরে আসবেন, তখন আমি যাব । আমি তবু বলিলাম, না, কােজ নেই মা । তখন মনােরম প্রস্তুত হইতে গেল। আমি তাহার শ্বশুরবাড়ির চাকর ও পালকির বোহারাদিগকে খাওয়াইবার আয়োজনে ব্যস্ত রহিলাম। যাইবার আগে একটু যে তাহার কাছে থাকিব, সেদিন যে একটু বিশেষ করিয়া তাহার যত্ন লাইব, নিজের হাতে তাহাকে সাজাইয়া দিব, সে যে খাবার ভালোবাসে তাহাই তাহাকে খাওয়াইয়া দিয়া বিদায় দিব, এমন অবকাশ পাইলাম না। ঠিক পালকিতে উঠিবার আগে আমাকে প্ৰণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইয়া কহিল, মা, আমি তবে চলিলাম । সে যে সত্যই চলিল সে কি আমি জানিতাম ? সে যাইতে চাহে নাই, আমি জোর করিয়া তাহাকে বিদায় করিয়াছি— এই দুঃখে বুক আজ পর্যন্ত পুড়িতেছে, সে আর কিছুতেই শীতল হইল না । সেই রাত্রেই গর্ভপাত হইয়া মনােরমার মৃত্যু হইল। এই খবর যখন পাইলাম তাহার পূর্বেই গোপনে তাড়াতাড়ি তাহার সৎকার শেষ হইয়া গেছে। যাহার কিছু বলিবার নাই, করিবার নাই, ভাবিয়া যাহার কিনারা পাওয়া যায় না, কঁাদিয়া যাহার অন্ত হয় না, সেই দুঃখ যে কী দুঃখ, তাহা তোমরা বুঝিবে না- সে বুঝিয়া কাজ নাই। আমার তো সবই গেল কিন্তু তবু আপদ চুকিল না। আমার স্বামীপুত্রের মৃত্যুর পর হইতেই দেবীররা আমার বিষয়ের প্রতি লোভ দিতেছিল। তাহারা জানিত আমার মৃত্যুর পরে বিষয়সম্পত্তি সমুদয় তাহাদেরই হইবে, কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তাহাদের সবুর সহিতেছিল না। ইহাতে কাহারও দোষ দেওয়া চলে না ; সত্যই আমার মতো অভাগিনীর বীচিয়া থাকাই যে অপরাধ। সংসারে যাহাদের নানা প্রয়োজন আছে, আমার মতো প্রয়োজনীয় লোক বিনা হেতুতে তাহাদের জায়গা জুড়িয়া বাঁচিয়া থাকিলে লোকে সহ্য করে কেমন করিয়া !