পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G NR NR রবীন্দ্র-রচনাবলী পড়িয়াছিলেন । তা কী করিব ! তোদের মা যে আমার এক মায়ের পেটের বোন । কাশীতে এক ভদ্রলোকের কাছে তােমাদের খোজ পাইয়া এখানে আসিয়াছি। পরেশবাবু শুনিয়াছি ঠাকুর-দেবতা মানেন না, কিন্তু ঠাকুর যে উহার প্রতি প্ৰসন্ন সে উহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। পূজা পাইলেই ঠাকুর ভোলেন না, সে আমি খুব জানি— পরেশবাবু কেমন করিয়া তাহাকে বশ করিলেন সেই খবর আমি লইব । যাই হােক বাছা, একলা থাকিবার সময় এখনো আমার হয় নাই— সে আমি পারি না— ঠাকুর যেদিন দয়া করেন করবেন, কিন্তু তোমাদের কোলের কাছে না। রাখিয়া আমি বঁচিব না । \b পরেশ বরদাসুন্দরীর অনুপস্থিতিকালে হরিমোহিনীকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। ছাতের উপরকার নিভৃত ঘরে তাহাকে স্থান দিয়া যাহাতে তাহার আচার রক্ষা করিয়া চলার কোনো বিঘ্ন না ঘটে তাহার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন । বরদাসুন্দরী ফিরিয়া আসিয়া তাহার ঘরকন্নার মধ্যে এই একটি অভাবনীয় প্রাদুর্ভাব দেখিয়া একেবারে হাড়ে হাড়ে জুলিয়া গেলেন । তিনি পরেশকে খুব তীব্র স্বরেই কহিলেন, “এ আমি পারব না।” পরেশ কহিলেন, “তুমি আমাদের সকলকেই সহ্য করতে পারছি, আর ঐ একটি বিধবা অনাথাকে সইতে পারবে না ?” বরদাসুন্দরী জানিতেন। পরেশের কাণ্ডজ্ঞান কিছুমাত্ৰ নাই, সংসারে কিসে সুবিধা ঘটে বা অসুবিধা ঘটে সে সম্বন্ধে তিনি কোনোদিন বিবেচনামাত্র করেন না— হঠাৎ এক-একটা কাণ্ড করিয়া বসেন । তাহার পরে রাগই করো, বকে আর কাদো, একেবারে পাষাণের মূর্তির মতো স্থির হইয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কে পারিয়া উঠিবে বলো | প্রয়োজন হইলে যাহার সঙ্গে ঝগড়া করাও অসম্ভব তাহার সঙ্গে ঘর করিতে কোন স্ত্রীলোক পারে ! সুচরিতা মনোরমার প্রায় একবয়সী ছিল । হরিমোহিনীর মনে হইতে লাগিল সুচরিতাকে দেখিতেও যেন অনেকটা সেই মনােরমারই মতো ; আর স্বভাবটিও তাহার সঙ্গে মিলিয়াছে। তেমনি শান্ত অথচ তেমনি দৃঢ় ৷ হঠাৎ পিছন হইতে তাহাকে দেখিয়া এক-এক সময় হরিমোহিনীর বুকের ভিতরটা যেন চমকিয়া উঠে । এক-এক দিন সন্ধ্যাবেলায় অন্ধকারে তিনি একলা বসিয়া নিঃশব্দে কাদিতেছেন, এমন সময় সুচরিতা কাছে আসিলে চােখ বুজিয়া তাহাকে দুই হাতে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন, “আহা আমার মনে হচ্ছে, যেন আমি তাকেই বুকের মধ্যে পেয়েছি। সে যেতে চায় নি, আমি তাকে জোর করে বিদায় করে দিয়েছি, জগৎ-সংসারে কি কোনোদিন কোনোমতেই আমার সে শাস্তির অবসান হবে না ! দণ্ড যা পাবার তা পেয়েছি— এবার সে এসেছে ; এই-যে ফিরে এসেছে ; তেমনি হাসিমুখ করে ফিরে এসেছে ; এই-যে আমার মা, এই-যে আমার মণি, আমার ধন ! এই বলিয়া সুচরিতার সমস্ত মুখে হাত বুলাইয়া, তাহাকে চুমো খাইয়া, চােখের জলে ভাসিতে থাকেন ; সুচরিতারও দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িত । সে তাহার গলা জড়াইয়া বলিত, “মাসি, আমিও তো মায়ের আদর বেশি দিন ভোগ করতে পারি নি ; আজ আবার সেই হারানো মা ফিরে এসেছেন। কত দিন কত দুঃখের সময় যখন ঈশ্বরকে ডাকবার শক্তি ছিল না, যখন মনের ভিতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল, তখন আমার মাকে ডেকেছি। সেই মা আজ আমার ডাক শুনে এসেছেন।” হরিমোহিনী বলিতেন, “আমন করে বলিস নে, বলিস নে ! তোর কথা শুনলে আমার এত আনন্দ হয় যে আমার ভয় করতে থাকে। হে ঠাকুর, দৃষ্টি দিয়ে না ঠাকুর । আর মায়া করব না মনে করি।-- মনটাকে পাষণ করেই থাকতে চাই কিন্তু পারি। নে যে। আমি বড়ো দুর্বল, আমাকে দয়া করে, আমাকে আর মেরো না ! ওরে রাধারানী, যা, যা, আমার কাছ থেকে ছেড়ে যা । আমাকে আর জড়াস নে রে, জড়াস নো! ও আমার গােপীবল্লভ, আমার জীবননাথ, আমার গোপাল, আমার নীলমণি, আমাকে এ আবার কী বিপদে ফেলছ ?”