পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(5igi GRàd পারি নে। আমাকে বসতে বললে আমি বসবই এইরকম আমার স্বভাব। অতএব, দিদির প্রতি নিবেদন এই যে, এসব কথা যেন বুঝে-সুঝে বলেন, নইলে বিপদে পড়বেন।” হারানবাবু কোনো কথা না বলিয়া আসন্ন ঝড়ের মতো স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তিনি নীরবে প্রকাশ করিলেন- "আচ্ছা বেশ, আমি অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলাম, আমার যা কথা আছে তাহা শেষ পর্যন্ত বলিয়া তবে আমি উঠিব ।” দ্বারের বাহির হইতে বিনয়ের কণ্ঠস্বর শুনিয়াই ললিতার বুকের ভিতরকার সমস্ত রক্ত যেন চমক খাইয়া উঠিয়ছিল। সে বহুকষ্টে আপনার স্বাভাবিক ভাব রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই পারিল না । বিনয় যখন ঘরে প্রবেশ করিল। ললিতা বেশ সহজে তাঁহাদের পরিচিত বন্ধুর মতো তাহাকে কোনো কথা বলিতে পারিল না। কোন দিকে চাহিবে, নিজের হাতখানা লইয়া কী করিবে, সে যেন একটা ভাবনার বিষয় হইয়া পড়িল ৷ একবার উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু সুচরিতা কোনোমতেই তাহার কাপড় ছাড়িল না। বিনয়ও যাহা-কিছু কথাবার্তা সমস্ত সুচরিতার সঙ্গেই চালাইল, ললিতার নিকট কোনো কথা ফাদা তাহার মতো বাকপটু লোকের কাছেও আজ শক্ত হইয়া উঠিল। এইজন্যই সে যেন ডবল জোরে সুচরিতার সঙ্গে আলাপ করিতে লাগিল, কোথাও কোনো ফাক পড়িতে দিল না। কিন্তু হারানবাবুর কাছে ললিতা ও বিনয়ের এই নূতন সংকোচ অগোচর রহিল না। যে ললিতা তাহার সম্বন্ধে আজকাল এমন প্রখর ভাবে প্ৰগলভ হইয়া উঠিয়াছে সে আজ বিনয়ের কাছে এমন সংকুচিত ইহা দেখিয়া তিনি মনে মনে জ্বলিতে লাগিলেন এবং ব্ৰাহ্মসমাজের বাহিরের লোকের সহিত কন্যাদের অবাধ পরিচয়ের অবকাশ দিয়া পরেশবাবু যে নিজের পরিবারকে কিরূপ কদাচারের মধ্যে লইয়া যাইতেছেন তাহা মনে করিয়া পরেশবাবুর প্রতি র্তাহার ঘূণা আরো বাড়িয়া উঠিল এবং পরেশবাবুকে যেন একদিন এজন্য বিশেষ অনুতাপ করিতে হয় এই কামনা তাহার মনের মধ্যে অভিশাপের মতো জাগিতে লাগিল । অনেকক্ষণ। এইভাবে চলিলে পর স্পষ্টই বুঝা গেল হারানবাবু উঠিবেন না। তখন সুচরিতা বিনয়কে কহিল, “মাসির সঙ্গে অনেক দিন আপনার দেখা হয় নি। তিনি আপনার কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন । একবার তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না ?” বিনয় চৌকি হইতে উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “মাসির কথা আমার মনে ছিল না। এমন অপবাদ আমাকে দেবেন না ।” সুচরিতা যখন বিনয়কে তাহার মাসির কাছে লইয়া গেল তখন ললিতা উঠিয়া কহিল, “পানুবাবু, আমার সঙ্গে আপনার বোধ হয় বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই।” হারানবাবু কহিলেন, “না। তোমার বোধ হয় অন্যত্র বিশেষ প্রয়োজন আছে। তুমি যেতে পারো ।” ললিতা কথাটার ইঙ্গিত বুঝিতে পারিল । সে তৎক্ষণাৎ উদ্ধত ভাবে মাথা তুলিয়া ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করিয়া দিয়া কহিল, “বিনয়বাবু আজ অনেক দিন পরে এসেছেন, তীর সঙ্গে গল্প করতে যাচ্ছি। ততক্ষণ আপনি নিজের লেখা যদি পড়তে চান তা হলে— না ঐ যা, সে কাগজখানা দিদি দেখছি কুটি কুঁটি করে ফেলেছেন। পরের লেখা। যদি সহ্য করতে পারেন তা হলে এইগুলি দেখতে পারেন।” বলিয়া কোণের টেবিল হইতে সযতুরক্ষিত গোরার রচনাগুলি আনিয়া হারানবাবুর সম্মুখে রাখিয়া দ্রুত পদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । হরিমোহিনী বিনয়কে পাইয়া অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করিলেন। কেবল যে এই প্রিয়দর্শন যুবকের প্রতি স্নেহবশত তাহা নহে। এ বাড়িতে বাহিরের লোক যে-কেহ হরিমােহিনীর কাছে আসিয়াছে । সকলেই তঁহাকে যেন কোনো এক ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণীর মতো দেখিয়াছে। তাহারা কলিকাতার লোক, খ্ৰীয় সকলেই ইংরেজি ও বাংলা লেখাপড়ায় তাহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ- তাহাদের দূরত্ব ও অবজ্ঞার আঘাতে তিনি অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া পড়িতেছিলেন। বিনয়কে তিনি আশ্রয়ের মতো অনুভব