পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ○○& 8良 পরদিন প্ৰাতে হরিমোহিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া পরেশকে প্ৰণাম করিতেই তিনি ব্যস্ত হইয়া সরিয়া গিয়া হরিমোহিনী অশ্রুনেত্ৰে কহিলেন, “তোমার ঋণ আমি কোনো জন্মে শোধ করতে পারব না। আমার মতো এত বড়ো নিরুপায়ের তুমি উপায় করে দিয়েছ, এ তুমি ভিন্ন আর কেহ করতে পারত না । ইচ্ছা! করলেও আমার ভালো কেউ করতে পারে না। এ আমি দেখেছি— তোমার উপর ভগবানের খুব অনুগ্রহ আছে তাই তুমি আমার মতো লোকের উপরেও অনুগ্রহ করতে পেরেছ।” গুরুত্ব অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিলেন কহিলেন, “আমি বিশেষ কিছুই করি নি—এসমস্ত রাধারন-” হরিমোহিনী বাধা দিয়া কহিলেন, “জানি জানি— কিন্তু রাধারানীই যে তোমার— ও যা করে সে যে তোমারই করা । ওর যখন মা গেল, ওর বাপও রইল না, তখন ভেবেছিলুম মেয়েটা বড়ো দুৰ্ভাগিনী— কিন্তু ওরা দুঃখের কপালকে ভগবান যে এমন ধন্য করে তুলবেন তা কেমন করে জানব বলে । দেখো, ঘুরে ফিরে শেষে আজ তোমার দেখা যখন পেয়েছি তখন বেশ বুঝতে পেরেছি। ভগবান আমাকেও দয়া করেছেন ।” “মাসি, মা এসেছেন তোমাকে নেবার জন্যে” বলিয়া বিনয় আসিয়া উপস্থিত হইল। সুচরিতা বিনয় কহিল, “নীচে আপনার মা'র কাছে বসে আছেন।” সুচরিতা তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেল । পরেশবাবু, হরিমোহিনীকে কহিলেন, “আমি আপনার বাড়িতে জিনিসপত্র সমস্ত গুছিয়ে দিয়ে আসি (5. " পরেশবাবু চলিয়া গেলে বিস্মিত বিনয় কহিল, “মাসি, তোমার বাড়ির কথা তো জানতুম না ।” হরিমোহিনী কহিলেন, “আমিও যে জানতুম না বাবা ! জানতেন কেবল পরেশবাবু । আমাদের রাধারানীর বাড়ি ।” বিনয় সমস্ত বিবরণ শুনিয়া কহিল, “ ভেবেছিলুম। পৃথিবীতে বিনয় একজন কারও একটা কোনো কাজে লাগবে | তাও ফসকে গেল । এ পর্যন্ত মায়ের তো কিছুই করতে পারি নি, যা করবার সে তিনিই আমার করেন— মাসিরও কিছু করতে পারব না, তার কাছ থেকেই আদায় করব । আমার ঐ নেবারই কপাল, দেবার নয় ।” কিছুক্ষণ পরে ললিতা ও সুচরিতার সঙ্গে আনন্দময়ী আসিয়া উপস্থিত হইলেন । হরিমোহিনী অগ্রসর হইয়া গিয়া কহিলেন, “ভগবান যখন দয়া করেন তখন আর কৃপণতা করেন না- দিদি, তোমাকেও আজ পেলুম।” বলিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে আনিয়া মাদুরের পরে বসাইলেন । হরিমোহিনী কহিলেন, “দিদি, তোমার কথা ছাড়া বিনয়ের মুখে আর কোনো কথা নেই।” আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “ ছেলেবেলা থেকেই ওর ঐ রোগ, যে কথা ধরে সে কথা শীঘ্ৰ ছাড়ে না । শীঘ মাসির পালাও শুরু হবে ।” বিনয় কহিল, “তা হবে, সে আমি আগে থাকতেই বলে রাখছি। আমার অনেক বয়সের মাসি, নিজে সংগ্রহ করেছি, এতদিন যে বঞ্চিত ছিলুম নানারকম করে সেটা পুষিয়ে নিতে হবে।” মানন্দময়ী ললিতার দিকে চাহিয়া সহস্যে কহিলেন, “আমাদের বিনয় ওর যা অভাব তা সংগ্ৰহ করতেও জানে আর সংগ্রহ করে প্রাণমনে তার আদর করতেও জানে। তোমাদের ও যে কী চোখে দেখেছে সে আমিই জানি— যা কখনো ভাবতে পারত না তারই যেন হঠাৎ সাক্ষাৎ পেয়েছে। তোমাদের সঙ্গে ওদের জানাশোনা হওয়াতে আমি যে কত খুশি হয়েছি সে আর কী বলব মা ! V9||\S)(