পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(t8 S রবীন্দ্র-রচনাবলী এতদিন পর্যন্ত সুচরিতা নানা ছুতা করিয়া পরেশবাবুর কত-কী ছােটােখাটাে কাজ করিয়া আসিয়াছে। হয়তো ফুলদানিতে ফুল সাজাইয়াছে, টেবিলের উপর বই গুছাইয়াছে, নিজের হাতে বিছানা রৌদ্রে দিয়াছে, স্নানের সময় প্রত্যহ তাহাকে খবর দিয়া স্মরণ করাইয়া দিয়াছে— এই সমস্ত অভ্যস্ত কাজের কোনাে গুরুত্বই প্রতিদিন কোনো পক্ষ অনুভব করে না। কিন্তু এ-সকল অনাবশ্যক কাজও যখন বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার সময় উপস্থিত হয় তখন এই সকল ছোটোখাটাে সেবা, যাহা একজনে না করিলে অনায়াসে আর-এক জনে করিতে পারে, যাহা না করিলেও কাহারও বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, এইগুলিই দুই পক্ষের চিত্তকে মথিত করিতে থাকে। সুচরিতা আজকাল যখন পরেশের ঘরের কোনো সামান্য কাজ করিতে আসে তখন সেই কাজটা পরেশের কাছে মস্ত হইয়া দেখা দেয় ও র্তাহার বক্ষের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস জমা হইয়া উঠে । এবং এই কাজ আজ বাদে কাল অন্যের হাতে সম্পন্ন হইতে থাকিবে এই কথা মনে করিয়া সুচরিতার চােখ ছলছল করিয়া আসে। যেদিন মধ্যাহ্নে আহার করিয়া সুচরিতাদের নূতন বাড়িতে উঠিয়া যাইবার কথা সেদিন প্ৰাতঃকালে পরেশবাবু তাহার নিভৃত ঘরটিতে উপাসনা করিতে আসিয়া দেখিলেন, তাহার আসনের সম্মুখদেশ ফুল দিয়া সাজাইয়া ঘরের এক প্রান্তে সুচরিতা অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। লাবণ্য-লীলারাও উপাসনাস্থলে আজ আসিবে এইরূপ তাহারা পরামর্শ করিয়াছিল, কিন্তু ললিতা তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া আসিতে দেয় নাই। ললিতা জানিত, পরেশবাবুর নির্জন উপাসনায় যোগ দিয়া সুচরিতা যেন বিশেষভাবে তাহার আনন্দের অংশ ও আশীর্বাদ লাভ করিত— আজি প্ৰাতঃকালে সেই আশীর্বাদ সঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য সুচরিতার যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাঁহাই অনুভব করিয়া ললিতা আদ্যকার উপাসনার নির্জনতা ভঙ্গ করিতে দেয় নাই । উপাসনা শেষ হইয়া গেল। তখন সুচরিতার চােখ দিয়া জল পড়িতেছে, পরেশবাবু কহিলেন, “ম, পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ে না, সম্মুখের পথে অগ্রসর হয়ে যাও— মনে সংকোচ রেখে না। যাই ঘটুক, যাই তোমার সম্মুখে উপস্থিত হােক, তার থেকে সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে ভালোকে গ্রহণ করবে: এই পণ করে আনন্দের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। ঈশ্বরকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমৰ্পণ করে তাকেই নিজের একমাত্র সহায় করো— তা হলে ভুল ত্রুটি ক্ষতির মধ্যে দিয়েও লাভের পথে চলতে পারবে— আর যদি নিজেকে আধা-আধি ভাগ করো, কতক ঈশ্বরে কতক অন্যত্রে, তা হলে সমস্ত কঠিন হয়ে উঠবে। ঈশ্বর এই করুন, তোমার পক্ষে আমাদের ক্ষুদ্র আশ্রয়ের আর যেন প্রয়োজন না হয় ।” উপাসনার পরে উভয়ে বাহিরে আসিয়া দেখিলেন বসিবার ঘরে হারানবাবু অপেক্ষা করিয়া আছেন। সুচরিতা আজ কাহারও বিরুদ্ধে কোনাে বিদ্রোহভাব মনে রাখিবে না পণ করিয়া হারানবাবুকে নম্রভাবে নমস্কার করিল। হারানবাবু তৎক্ষণাৎ চৌকির উপরে নিজেকে শক্ত করিয়া তুলিয়া অত্যন্ত গভীর স্বরে কহিলেন, “সুচরিতা, এতদিন তুমি যে সত্যকে আশ্রয় করে ছিলে আজ তার থেকে পিছিয়ে পড়তে যােচ্ছ, আজ আমাদের শোকের দিন ।” সুচরিতা কোনো উত্তর করিল না। কিন্তু যে রাগিণী তাহার মনের মধ্যে আজ শান্তির সঙ্গে করুণা মিশাইয়া সংগীতে জমিয়া উঠিতেছিল তাহাতে একটা বেসুর আসিয়া পড়িল । পরেশবাবু কহিলেন, “অন্তর্যামী জানেন কে এগোচ্ছে, কে পিছোচ্ছে, বাইরে থেকে বিচার করে আমরা বৃথা উদবিগ্ন হই ।” হারানবাবু কহিলেন, “তা হলে আপনি কি বলতে চান আপনার মনে কোনো আশঙ্কা নেই ? আর আপনার অনুতাপেরও কোনো কারণ ঘটে নি ?” পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবু, কাল্পনিক আশঙ্কাকে আমি মনে স্থান দিই নে এবং অনুতাপের কারণ, ঘটেছে কি না তা তখনই বুঝব যখন অনুতাপ জন্মাবে।” হারানবাবু কহিলেন, “এই-যে আপনার কন্যা ললিত একলা বিনয়বাবুর সঙ্গে স্টীমারে করে চলে ७q(लन्म ७७ कि काअकि ?' সুচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল। পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবু, আপনার মন যে-কোনাে কারণে