পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (ሶ (፩ » জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু ? এবং বিনয় তাহা স্বীকার করিলে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন- ‘হিন্দুসমােজ আপনি তো ত্যাগ করিতে পরিবেন না ? এবং বিনয় তাহা তাহার পক্ষে অসম্ভব জনাইলে বরদাসুন্দরী যখন বলিয়া উঠিলেন। তবে কেন আপনি— তখন সেই "তবে কেনার কোনো উত্তর বিনয়ের মুখে জোগাইল না। সে একেবারে মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার মনে হইল সে যেন ধরা পড়িয়াছে; তাহার এমন একটা জিনিস এখানে সকলের কাছে প্রকাশ হইয়া পডিয়াছে যাহা সে চন্দ্ৰসূৰ্যবায়ুর কাছেও গোপন করিতে চাহিয়াছিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল— পরেশবাবু কী মনে করিতেছেন, ললিতা কী মনে করিতেছে, সুচরিতাই বা তাহাকে কী ভাবিতেছে! দেবদূতের কোন ভ্রমক্রমে এই-যে স্বৰ্গলোকে কিছুদিনের মতো তাহার স্থান হইয়াছিল— অনধিকার-প্রবেশের সমস্ত লজ্জা মাথায় করিয়া লইয়া এখান হইতে আজ তাহাকে একেবারে নির্বাসিত হইতে হইবে । তাহার পরে পরেশের দরজা পার হইয়াই প্রথমেই যেই সে ললিতাকে দেখিতে পাইল তাহার মনে হইল “ললিতার নিকট হইতে এই শেষ-বিদায়ের মুহুর্তে তাহার কাছে একটা মস্ত অপমান স্বীকার করিয়া লইয়া পূর্বপরিচয়ের একটা প্ৰলয় সমাধান করিয়া দিয়া যাই'- কিন্তু কী করিলে তাহা হয় ভাবিয়া পাইল না ; তাই ললিতার মুখের দিকে না চাহিয়া নিঃশব্দে একটি নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল ! এই তো সেদিন পর্যন্ত বিনয় পরেশের পরিবারের বাহিরেই ছিল— আজও সেই বাহিরে আসিয়া দীড়াইল। কিন্তু এ কী প্রভেদ ! সেই বাহির আজ এমন শূন্য কেন ? তাহার পূর্বের জীবনে তো কোনাে ক্ষতি হয় নাই— তাহার গোরা, তাহার আনন্দময়ী তো আছে। কিন্তু তবু তাহার মনে হইতে লাগিল মাছ যেন জল হইতে ডাঙায় উঠিয়াছে— যে দিকে ফিরিতেছে কোথাও সে যেন জীবনের অবলম্বন পাইতেছে না। এই হর্ম্যসংকুল শহরের জনাকীর্ণ রাজপথে বিনয় সর্বত্রই নিজের জীবনের একটা ছায়াময় পাণ্ডুবৰ্ণ সর্বনাশের চেহারা দেখিতে লাগিল। এই বিশ্বব্যাপী শুষ্কতায় শূন্যতায় সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। কেন এমন হইল, কখন এমন হইল, কী করিয়া এ সম্ভব হইল, এই কথাই সে একটা হৃদয়হীন নিরুত্তর শূন্যের কাছে বার বার প্রশ্ন করিতে লাগিল। “বিনয়বাবু! বিনয়বাবু!” বিনয় পিছন ফিরিয়া দেখিল, সতীশ । তাহাকে বিনয় আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। কহিল, “কী ভাই, কী বন্ধু!” বিনয়ের কণ্ঠ যেন অশ্রুতে ভরিয়া আসিল। পরেশবাবুর ঘরে এই বালকটিও যে কতখানি মাধুর্য মিশাইয়াছিল তাহা বিনয় আজ যেমন অনুভব করিল এমন বুঝি কোনোদিন করে নাই। সতীশ কহিল, “আপনি আমাদের ওখানে কেন যান না ? কাল আমাদের ওখানে লাবণ্য দিদি ললিতাদিদি খাবেন, মাসি আপনাকে নেমস্তন্ন করবার জন্যে পাঠিয়েছেন।” বিনয় বুঝিল মাসি কোনাে খবর রাখেন না। কহিল, “সতীশবাবু, মাসিকে আমার প্রণাম জানিয়ো— কিন্তু আমি তো যেতে পারব না।” সতীশ অনুনয়ের সহিত বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “কোন পারবেন না ? আপনাকে যেতেই হবে, কিছুতেই ছাড়ব না।” সতীশের এত অনুরোধের বিশেষ একটু কারণ ছিল। তাহার ইস্কুলে “পশুর প্রতি ব্যবহার” সম্বন্ধে তীহাকে একটি রচনা লিখিতে দিয়াছিল, সেই রচনায় সে পঞ্চাশের মধ্যে বিয়াল্লিশ নম্বর পাইয়াছিলতাহার ভারি ইচ্ছা বিনয়কে সেই লেখাটা দেখায়। বিনয় যে খুব একজন বিদ্বান এবং সমজদার তাহা সে জানিত ; সে নিশ্চয় ঠিক করিয়াছিল বিনয়ের মতো রসজ্ঞ লোক তাহার লেখার ঠিক মূল্য বুঝিতে পরিবে। বিনয় যদি তাহার লেখার শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করে তাহা হইলে অরসিক লীলা সতীশের প্রতিভা । সম্বন্ধে অবজ্ঞা প্ৰকাশ করিলে আশ্রদ্ধেয় হইবে । নিমন্ত্রণটা মাসিকে বলিয়া সেই ঘটাইয়াছিল- বিনয় যখন তাহার লেখার উপরে রায় প্রকাশ করিবে তখন তাহার দিদিরাও সেখানে উপস্থিত থাকে। ইহাই তীহার ইচ্ছা । বিনয় কোনোমতেই নিমন্ত্রণে উপস্থিত হইতে পরিবে না শুনিয়া সতীশ অত্যন্ত মুষড়িয়া গেল।