পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (?(2O কোনোমতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। ললিতা যখন ভিন্নসমাজভুক্ত, তাহার সঙ্গে বিবাহ যখন সম্ভবপর নহে, তখন তাহার প্রতি বিনয়ের অনুরাগটাই একটা গোপন পাপের মতো তাহাকে ক্লিষ্ট করিতেছিল এবং এই পাপের নিদারুণ প্রায়শ্চিত্তকাল যে উপস্থিত হইয়াছে এই কথাই স্মরণ করিয়া সে পীড়িত হইতেছিল। বিনয় হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “মা, শশিমুখীর সঙ্গে আমার বিবাহের যে প্রস্তাব হয়েছিল সেটা হয়ে চুকে গেলেই ভালো হত। আমার যেখানে ঠিক জায়গা সেইখানেই কোনােমতে আমার বদ্ধ হয়ে থাকা উচিত— এমন হওয়া উচিত যে, কিছুতেই সেখান থেকে আর নড়তে না পারি।” আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “অর্থাৎ, শশিমুখীকে তোর ঘরের বউ না করে তোরা ঘরের শিকল করতে চাস- শশীর কী সুখেরই কপাল!” এমন সময় বেহারিা আসিয়া খবর দিল, পরেশবাবুর বাড়ির দুই মেয়ে আসিয়াছেন । শুনিয়া বিনয়ের বুকের মধ্যে ধড়াস করিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, বিনয়কে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য তাহারা আনন্দময়ীর কাছে নালিশ জানাইতে আসিয়াছে। সে একেবারে দাড়াইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি যাই .." নীচের ঘরে একটু অপেক্ষা কর।” নীচে যাইতে যাইতে বিনয় বার বার বলিতে লাগিল, ‘এর তো কোনো দরকার ছিল না । যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তো মরে গেলেও আর সেখানে যৌতুম না । অপরাধের শাস্তি আগুনের মতো যখন একবার জ্বলে ওঠে তখন অপরাধী দগ্ধ হয়ে ম'লেও সেই শাস্তির আগুন যেন নিবতেই চায় না ।” একতলায় রাস্তার ধারে গোরার যে ঘর ছিল সেই ঘরে বিনয় যখন প্রবেশ করিতে যাইতেছে এমন সময় মহিম তাহার স্ফীত উদরটিকে চাপিকানের বোতাম-বন্ধন হইতে মুক্তি দিতে দিতে আপিস হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন । বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “এই-যে বিনয় ! বেশ ! আমি তোমাকে খুঁজছি।” বলিয়া বিনয়কে গোরার ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া একটা চৌকিতে বসাইয়া নিজেও বসিলেন এবং পকেট হইতে ডিবা বাহির করিয়া বিনয়কে একটি পান খাইতে দিলেন । "ওরে তামাক নিয়ে আয় রে” বলিয়া একটা হুংকার দিয়া তিনি একেবারেই কাজের কথা পাড়িলেন । জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই বিষয়টার কী স্থির হল ? আর তো—” দেখিলেন বিনয়ের ভাবখানা পূর্বের চেয়ে অনেকটা নরম। খুব যে একটা উৎসাহ তাহা নয় বটে, কিন্তু ফাকি দিয়া কোনোমতে কথাটাকে এড়াইবার চেষ্টাও দেখা যায় না। মহিম তখনই দিন-ক্ষণ একেবারে পাকা করিতে চান ; বিনয় কহিল, “গোরা ফিরে আসুক-না।” মহিম আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, “সে তো আর দিন কয়েক আছে। বিনয়, কিছু জলখাবার আনতে বলে দিই— কী বল ? তোমার মুখ আজ ভরি শুকনাে দেখাচ্ছে যে ! কিছু অসুখ-বিসুখ করে নি Që ?” উত্তর গমন করিলেন। বিনয় গোরার টেবিলের উপর হইতে যে-কোনো একখানা বইটানিয়া লইয়া *াতী উলটাইতে লাগিল, তাহার পরে বই ফেলিয়া ঘরের এক ধার হইতে আর-এক ধার পর্যন্ত পায়চারি করিতে থাকিল । বোহারা আসিয়া কহিল, “মা ডাকছেন।” বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কাকে ডাকছেন ?” বেহার কহিল, “আপনাকে ৷” বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “আর-সকলে আছেন ?”