পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (፩(፩ ዓ সময় উপস্থিত হয়েছে।” সুচরিতা পরেশবাবুর মুখে তাহার করুণাপূর্ণ দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, “জানি বাবা!" পািরশবাবু কহিলেন, “আমি সামাজিক নিন্দার কথা ভাবছি নে। আমি ভাবছি— আচ্ছা ললিতা 帘一” পাৱেশের সংকোচ দেখিয়া সুচরিতা আপনিই কথাটাকে স্পষ্ট করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। সে কহিল, “ললিতা বরাবর তার মনের কথা আমার কাছে খুলে বলে। কিন্তু কিছুদিন থেকে সে আমার কাছে আর তেমন করে ধরা দেয় না। আমি বেশ বুঝতে পারছি—” পরেশ মাঝখান হইতে কহিলেন, “ললিতার মনে এমন কোনো ভাবের উদয় হয়েছে। যেটা সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাচ্ছে না। আমি ভেবে পাচ্ছি নে কী করলে ওর ঠিক- তুমি কি বল সুচরিতা কহিল, “বাবা, তুমি তো জান বিনয়বাবুর মধ্যে কোনো দোষ নেই— তীর নির্মল স্বভাবতীর মতো স্বভাবতই ভদ্রলোক খুব অল্পই দেখা যায়।” পরেশবাবু যেন একটা কোন নূতন তত্ত্ব লাভ করিলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা বলেছি, রাধে, ঠিক কথা বলেছ। তিনি ভালো লোক কিনা এইটেই দেখবার বিষয়- অন্তর্যামী ঈশ্বরও তাই দেখেন । বিনয় যে ভালো লোক, সেখানে যে আমার ভুল হয় নি, সেজন্যে আমি তাকে বার বার প্ৰণাম করি ।” একটা জাল কাটিয়া গেল— পরেশবাবু যেন বীচিয়া গেলেন। পরেশবাবু তাহার দেবতার কাছে অন্যায় করেন নাই। ঈশ্বর যে তুলাদণ্ডে মানুষকে ওজন করেন সেই নিত্যধর্মের তুলাকেই তিনি মানিয়াছেন— তাহার মধ্যে তিনি নিজের সমাজের তৈরি কোনো কৃত্রিম বাটখারা মিশন নাই বলিয়া তাহার মনে আর কোনো গ্লানি রহিল না । এই অত্যন্ত সহজ কথাটা এতক্ষণ তিনি না বুঝিয়া কেন এমন পীড়া অনুভব করিতেছিলেন বলিয়া তাহার আশ্চর্য বােধ হইল। সুচরিতার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, “তোমার কাছে আমার আজ একটা শিক্ষা হল মা !” সুচরিতা তৎক্ষণাৎ তাহার পায়ের ধূলা লইয়া কহিল, “না না, কী বল বাবা!” পরেশবাবু কহিলেন, “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিয়ে দেয়— মানুষ ব্ৰাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্বসত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে— এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।” একটু চুপ করিয়া থাকিয়া পরেশ কহিলেন, “ললিতা তার মেয়ে-ইস্কুলের সংকল্প কিছুতেই ছাড়তে পারছে না । সে এ সম্বন্ধে বিনয়ের সাহায্য নেবার জন্যে আমার সম্মতি চায়।” সুচরিতা কহিল, “না। বাবা, এখন কিছুদিন থাক।” ললিতাকে তিনি নিষেধ করিবামাত্র সে যে তাহার ক্ষুব্ধ হৃদয়ের সমস্ত বেগ দমন করিয়া উঠিয়া চলিয়া গৈল সেই ছবিটি পরেশের স্নেহপূর্ণ হৃদয়কে অত্যন্ত ক্লেশ দিতেছিল। তিনি জানিতেন, তাহার তেজস্বিনী কন্যার প্রতি সমাজ যে অন্যায় উৎপীড়ন করিতেছে সেই অন্যায়ে সে তেমন কষ্ট পায় নাই যেমন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্ৰাম করিতে বাধা পাইয়া, বিশেষত পিতার নিকট হইতে বাধা পাইয়া । এইজন্য তিনি তাহার নিষেধ উঠাইয়া লইবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিলেন। তিনি কহিলেন, “কোন রাধে, এখন থাকবে কেন ?” সুচরিতা কহিল, “নইলে মা ভারি বিরক্ত হয়ে উঠবেন।” পরেশ ভাবিয়া দেখিলেন সে কথা ঠিক । সতীশ ঘরে ঢুকিয়া সুচরিতার কানে কানে কী কহিল। সুচরিতা কহিল, “না ভাই ব্যক্তিয়ার, এখন R | কাল হবে ।” সতীশ বিমর্ষ হইয়া কহিল, “কাল যে আমার ইস্কুল আছে৷ ” পরেশ স্নেহহাস্য হাসিয়া কহিলেন, “কী সতীশ, কী চাই ?”