পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩(፩br রবীন্দ্র-রচনাবলী সুচরিতা কহিল, “ওর একটা—” সতীশ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া সুচরিতার মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, “না না, বোলো না, বোলো না।” পরেশবাবু কহিলেন, “যদি গোপন কথা হয় তা হলে সুচরিতা বলবে কেন ?” সুচরিতা কহিল, “না। বাবা, নিশ্চয় ওর ভারি ইচ্ছে যাতে এই গোপন কথাটা তোমার কানে ওঠে।” সতীশ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “ককখনো না, নিশ্চয় না।” लिशा (ल (नीg निल । বিনয় তাহার যে রচনার এত প্রশংসা করিয়াছিল সেই রচনাটা সুচরিতাকে দেখাইবার কথা ছিল। বলা বাহুল্য পরেশের সামনে সেই কথাটা সুচরিতার কানে কানে স্মরণ করাইয়া দিবার উদ্দেশ্যটা যে কী তাঁহা সুচরিতা ঠিক ঠাওরাইয়াছিল। এমন সকল গভীর মনের অভিপ্রায় সংসারে যে এত সহজে ধরা পড়িয়া যায়, বেচারা সতীশের তাহা জানা ছিল না । 8ዔ চারি দিন পরে একখানি চিঠি হাতে করিয়া হারানবাবু বরদাসুন্দরীর কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আজকাল পরেশবাবুর আশা তিনি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছেন। হারানবাবু চিঠিখনি বরদাসুন্দরীর হাতে দিয়া কহিলেন, “আমি প্রথম হতেই আপনাদের সাবধান করে দিতে অনেক চেষ্টা করেছি। সেজন্যে আপনাদের অপ্রিয়ও হয়েছি। এখন এই চিঠি থেকেই বুঝতে পারবেন ভিতরে ভিতরে ব্যাপারটা কতদূর এগিয়ে পড়েছে।” শৈলবালাকে ললিতা যে চিঠি লিখিয়াছিল। সেই চিঠিখানি বরদাসুন্দরী পাঠ করিলেন। কহিলেন, “কেমন করে জানব বলুন। কখনাে যা মনেও করতে পারি নি। তাই ঘটছে। এর জন্যে কিন্তু আমাকে দোষ দেবেন না তা আমি বলে রাখছি। সুচরিতাকে যে আপনারা সকলে মিলে বড়ো ভালো ভালো করে একেবারে তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন- ব্ৰাহ্মসমাজে। অমন মেয়ে আর হয় না— এখন আপনাদের ঐ আদর্শ ব্ৰাহ্ম মেয়েটির কীর্তি সামলান। বিনয়-গীেরকে তো উনিই এ বাড়িতে এনেছেন। আমি তবু বিনয়কে অনেকটা আমাদের পথেই টেনে আনছিলুম, তার পরে কোথা থেকে উনি ওঁর এক মাসিকে এনে আমাদেরই ঘরে ঠাকুর-পূজো শুরু করে দিলেন। বিনয়কেও এমনি বিগড়ে দিলেন যে, সে এখন আমাকে দেখলেই পালায়। এখন এ-সব যা-কিছু ঘটছে আপনাদের ঐ সুচরিত্যই এর গোড়ায়। ও মেয়ে যে কেমন মেয়ে সে আমি বরাবরই জানতুম— কিন্তু কখনাে কোনাে কথাটি কই নি, বরাবর ওকে এমন করেই মানুষ করে এসেছি যে কেউ টের পায় নি ও আমার আপনি মেয়ে নয়- আজ তার বেশ ফল পাওয়া গেল। এখন আমাকে এ চিঠি মিথ্যা দেখাচ্ছেন- আপনার যা হয় করুন।” হারানবাবু যে এক সময় বরদাসুন্দরীকে ভুল বুঝিয়াছিলেন সে কথা আজ স্পষ্ট স্বীকার করিয়া অত্যন্ত উদারভাবে অনুতাপ প্রকাশ করিলেন। অবশেষে পরেশবাবুকে ডাকিয়া আনা হইল। “এই দেখো”। বলিয়া বরদাসুন্দরী চিঠিখানা তঁহার সম্মুখে টেবিলের উপর ফেলিয়া দিলেন। পরেশবাবু দু-তিন বার চিঠিখানা পড়িয়া কহিলেন, “তা, কী হয়েছে ?” বরদাসুন্দরী উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “কী হয়েছে! আর কী হওয়া চাই। আর বাকি রইলই বা কী ! ঠাকুর-পুজো, জাত মেনে চলা, সবই হল, এখন কেবল হিন্দুর ঘরে তােমার মেয়ের বিয়ে হলেই হয়। তার পরে তুমি প্ৰায়শ্চিত্ত করে হিন্দুসমাজে ঢুকবে- আমি কিন্তু বলে রাখছি।-" * পরেশ ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। অন্তত এখনো বলবার সময় ইষ্ট নি। কথা হচ্ছে এই যে, তোমরা কেন ঠিক করে বসে আছ হিন্দুর ঘরেই ললিতার বিবাহ স্থির হয়ে গেছে। এ চিঠিতে তো সেরকম কিছুই দেখছি নে ৷” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কী হলে যে তুমি দেখতে পাও সে তাে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলুম না।