পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

QWりWり রবীন্দ্র-রচনাবলী সুচরিতার অত্যন্ত গোল ঠেকিল ; সে কহিল, “সে কেমন করে সম্ভব হবে আমি তো বুঝতে পারছি (ଲ ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার কাছে। এ তো খুবই সহজ ঠেকছে মা ! দেখো আমার বাড়িতে যে নিয়ম চলে সে নিয়মে আমি চলতে পারি নে— সেইজন্য আমাকে কত লোকে খৃস্টান বলে । কোনো ক্রিয়াকর্মের সময়ে আমি ইচ্ছা করেই তফাত হয়ে থাকি । তুমি শুনে হাসবে মা, গোরা আমার ঘরে জল খায় না । কিন্তু তাই বলে আমি কেন বলতে যাব, এ ঘর আমার ঘর নয়, এ সমাজ আমার সমাজ নয় । আমি তো বলতে পারিই নে । সমস্ত গালমন্দ মাথায় করে নিয়েই আমি এই ঘর এই সমাজ নিয়ে আছি। তাতে তো আমার এমন কিছু বাধছে না। যদি এমন বাধে যে আর চলে না। তবে ঈশ্বর যে পথ দেখাবেন সেই পথ ধরব । কিন্তু শেষ পর্যন্তই যা আমার তাকে আমারই বলব— তারা যদি আমাকে স্বীকার না করে তবে সে তারা বুকুক ৷” সুচরিতার কাছে এখনো পরিষ্কার হইল না ; সে কহিল, “কিন্তু, দেখুন, ব্ৰাহ্মসমাজের যা মন্ত বিনয়বাবুর যদি—” আনন্দময়ী কহিলেন, “তার মতও তো সেইরকমই। ব্ৰাহ্মসমাজের মত তো একটা সৃষ্টিছাড়া মত নয় । তোমাদের কাগজে যে-সব উপদেশ বেরোয়, ও তো আমাকে প্রায়ই সেগুলি পড়ে শোনায়--- কোনখানে তফাত বুঝতে তো পারি। নে ৷” এমন সময় “সুচিদিদি" বলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াই আনন্দময়ীকে দেখিয়া ললিতা লজ্জায় লাল হইয়া উঠিল । সে সুচরিতার মুখ দেখিয়াই বুঝিল এতক্ষণ তাহারই কথা হইতেছিল । ঘর হইতে পালাইতে পারিলেই সে যেন রক্ষা পাইত, কিন্তু তখন আর পালাইবার উপায় ছিল না । আনন্দময়ী বলিয়া উঠিলেন, “এসো ললিতা, মা এসো ।” বলিয়া ললিতার হাত ধরিয়া তাহাকে একটু বিশেষ কাছে টানিয়া লইয়া বসাইলেন, যেন ললিতা তাহার একটু বিশেষ আপন হইয়া উঠিয়াছে । তাহার পূর্বকথার অনুবৃত্তিস্বরূপ আনন্দময়ী সুচরিতাকে কহিলেন, “দেখে মা, ভালোর সঙ্গে মন্দ মেলাই সব চেয়ে কঠিন— কিন্তু তবু পৃথিবীতে তাও মিলছে- আর তাতেও সুখে দুঃখে চলে যাচ্ছে- সব সময়ে তাতে মন্দই হয় তাও নয়, ভালোও হয় | এও যদি সম্ভব হল, তবে কেবল মতের একটুখানি অমিল নিয়ে দুজন মানুষ যে কেন মিলতে পারবে না। আমি তো তা বুঝতেই পারি। নে ? সুচরিতা মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমাদের ব্রাহ্মসমাজ ও কি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না ? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে ? মা, যে সমাজে ছোটাে অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই ? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে ? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এইজনেই হয়েছে ?” আনন্দময়ী যে এই বিষয়টি লইয়া এত আন্তরিক উৎসাহের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন সে কি কেবল ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহের বাধা দূর করিবার জন্যই ? সুচরিতার মনে এ সম্বন্ধে একটু দ্বিধার ভাব অনুভব করিয়া সেই দ্বিধাটুকু ভাঙিয়া দিবার জন্য তাহার সমস্ত মন যে উদ্যত হইয়া উঠিল ইহার মধ্যে আর-একটা উদ্দেশ্য কি ছিল না ? সুচরিতা যদি এমন সংস্কারে জড়িত থাকে। তবে সে যে কোনোমতেই চলিবে না । বিনয় ব্ৰাহ্ম না হইলে বিবাহ ঘটিতে পরিবে না। এই যদি সিদ্ধান্ত হয় তবে বড়ো দুঃখের সময়েও এই কয়দিন আনন্দময়ী যে আশা গড়িয়া তুলিয়াছিলেন সে যে ধূলিসাৎ হয় । আজই বিনয় এ প্রশ্ন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল ; বলিয়াছিল, “মা, ব্ৰাহ্মসমাজে কি নাম লেখাতে হবে ? সেও স্বীকার করব ?” আনন্দময়ী বলিয়াছিলেন, “না না, তার তো কোনো দরকাব দেখি নে ৷” বিনয় বলিল, “যদি তারা পীড়াপীড়ি করেন ?”