পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(s (ጵዓw9 সন্তানদের তুমি কোথায় দাড় করাচ্ছ সে কথা ভাববে না ?” বিনয় কহিল, “সেইরকম করে ভাবতে গিয়েই তো মানুষ সামাজিক অন্যায়কে চিরস্থায়ী করে তোলে। সাহেব-মনিবের লাথি খেয়ে যে কেরানি অপমান চিরদিন বহন করে তাকে তুমি দোষ দাও কেন ? সেও তো তার সন্তানদের কথাই ভাবে ।” গোরার সঙ্গে তর্কে বিনয় যে জায়গায় আসিয়া পৌঁছিল পূর্বে সেখানে সে ছিল না। একটু আগেই সমাজের সঙ্গে বিচ্ছেদের সম্ভাবনাতেই তাহার সমস্ত চিত্ত সংকুচিত হইয়াছিল। এ সম্বন্ধে সে নিজের সঙ্গে কোনোপ্রকার তর্কই করে নাই এবং গোরার সঙ্গে তর্ক যদি উঠিয়া না পড়িত। তবে বিনয়ের মন আপন চিরন্তন সংস্কার অনুসারে উপস্থিত প্রবৃত্তির উলটা দিকেই চলিত। কিন্তু তর্ক করিতে করিতে তাহার প্রবৃত্তি, কর্তব্য বুদ্ধিকে আপনার সহায় করিয়া লইয়া প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। গোরার সঙ্গে খুব তর্ক বাধিয়া গেল। এইরূপ আলোচনায় গোরা প্রায়ই যুক্তি-প্রয়োগের দিকে যায় না- সে খুব জোরের সঙ্গে আপনার মত বলে। তেমন জোর অল্প লোকেরই দেখা যায়। এই জোরের দ্বারাই আজ সে বিনয়ের সব কথা ঠেলিয়া ভূমিসাৎ করিয়া চলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু আজ সে বাধা পাইতে লাগিল । যতদিন এক দিকে গোরা আর-এক দিকে বিনয়ের মত মাত্র ছিল। ততদিন বিনয় হার মানিয়ছে, কিন্তু আজ দুই দিকেই দুই বাস্তব মানুষ— গােরা আজ বায়ুবাণের দ্বারা বায়ুবাণকে ঠেকাইতেছিল না, আজ বাণ যেখানে আসিয়া বাজিতেছিল। সেখানে বেদনাপূর্ণ মানুষের হৃদয় । শেষকালে গোরা কহিল, “আমি তোমার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করতে চাই নে । এর মধ্যে তর্কের কথা বেশি কিছু নেই, এর মধ্যে হৃদয় দিয়ে একটি বােঝবার কথা আছে। ব্রাহ্ম মেয়েকে বিয়ে করে তুমি দেশের সর্বসাধারণের সঙ্গে নিজেকে যে পৃথক করে ফেলতে চাও সেইটেই আমার কাছে অত্যন্ত বেদনার বিষয় । এ কাজ তুমি পাের, আমি কিছুতেই পারি নে, এইখানেই তোমাতে আমাতে প্রভেদজ্ঞানে নয়, বুদ্ধিতে নয়। আমার প্ৰেম যেখানে তোমার প্রেম সেখানে নেই। তুমি যেখানে ছুরি মেরে নিজেকে মুক্ত করতে চােচ্ছ সেখানে তোমার দরদ কিছুই নেই। আমার সেখানে নাড়ির টান। আমি আমার ভারতবর্ষকে চাই- তাকে তুমি যত দোষ দাও, যত গাল দাও, আমি তাকেই চাই ; তার চেয়ে বড়ো কািন আমি আপনাকে কি অন্য কোনো মানুষকেই চাই নে। আমি লেশমাত্র এমন কোনো কাজ করতে চাই নে যাতে আমার ভারতবর্ষের সঙ্গে চুলমাত্র বিচ্ছেদ ঘটে ।” বিনয় কী একটা উত্তর দিবার উপক্ৰম করিতেই গোরা কহিল, “না বিনয়, তুমি বৃথা আমার সঙ্গে তর্ক করছ। সমস্ত পৃথিবী যে ভারতবর্ষকে ত্যাগ করেছে, যাকে অপমান করছে, আমি তারই সঙ্গে এক অপমানের আসনে স্থান নিতে চাই- আমার এই জাতিভেদের ভারতবর্ষ, আমার এই কুসংস্কারের ভারতবর্ষ, আমার এই পৌত্তলিক ভারতবর্ষ। তুমি এর সঙ্গে যদি ভিন্ন হতে চাও তবে আমার সঙ্গেও छिद्म शत ।" এই বলিয়া গোরা উঠিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া ছাতে বেড়াইতে লাগিল। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বেহারা আসিয়া গোরাকে খবর দিল, অনেকগুলি বাবু তাহার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে। পলায়নের একটা উপলক্ষ পাইয়া গোরা আরাম বোধ করিল, সে চলিয়া গেল । বাহিরে আসিয়া দেখিল, অন্যান্য নানা লোকের মধ্যে অবিনাশও আসিয়াছে। গোরা স্থির করিয়াছিল অবিনাশ রাগ করিয়াছে। কিন্তু রাগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না । সে আরো উচ্ছসিত প্ৰশংসাবাকো তাহার গতকল্যকার প্রত্যাখ্যান-ব্যাপার সকলের কাছে বর্ণনা করিতেছিল। সে কহিল, “গীেরমোহনবাবুর প্রতি আমার ভক্তি অনেক বেড়ে গেছে ; এতদিন আমি জানতুম উনি অসামান্য লোক, কিন্তু কাল জানতে পেরেছি। উনি মহাপুরুষ। আমরা কাল ওঁকে সম্মান দেখাতে গিয়েছিলুম— উনি যেরকম প্রকাশ্যভাবে সেই সম্মানকে উপেক্ষা করলেন সেরকম আজকালকার দিনে কজন লোক পারে! এ কি সাধারণ কথা !" একে গোরার মন বিকল হইয়া ছিল, তাহার উপরে অবিনাশের এই উচ্ছাসে তাহার গা জ্বলিতে