পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (ሰዒ (ሰ ষড়ঋতু ! ভারতবর্ষে ষড়ঋতু আছে! সেই ষড়ঋতুর ষড়যন্ত্রে যদি অবিনাশের মতো এমন ফল ফলিয়া থাকে। তবে দুই-চারিটা ঋতু কম থাকিলে ক্ষতি ছিল না।” বেহারা আসিয়া খবর দিল, মা গোরাকে ডাকিতেছেন। গোরা যেন হঠাৎ চমকিয়া উঠিল । সে আপনার মনে বলিয়া উঠিল, “মা ডাকিতেছেন !" এই খবরটাকে সে যেন একটা নূতন অর্থ দিয়া শুনিল । সে কহিল, ‘আর যাই হউক, আমার মা আছেন । এবং তিনিই আমাকে ডাকিতেছেন । তিনিই আমাকে সকলের সঙ্গে মিলাইয়া দিবেন, কাহারও সঙ্গে তিনি কোনো বিচ্ছেদ রাখিবেন না । আমি দেখিব যাহারা আমার আপনি তাহারা তঁহার ঘরে বসিয়া আছে। জেলের মধ্যেও মা আমাকে ডাকিয়াছিলেন, সেখানে তাহার দেখা পাইয়াছি। জেলের বাহিরেও মা আমাকে ডাকিতেছেন, সেখানে আমি তাহাকে দেখিতে যাত্ৰা করিলাম ।’ এই বলিয়া গোরা সেই শীতমধ্যাহের আকাশের দিকে বাহিরে চাহিয়া দেখিল । এক দিকে বিনয় ও আর-এক দিকে অবিনাশের তরফ হইতে যে বিরোধের সুর উঠিয়ছিল তাহা যৎসামান্য হইয়া কাটিয়া গেল। এই মধ্যাহ্নসূর্যের আলোকে ভারতবর্ষ যেন তাহার বাহু উদঘাটিত করিয়া দিল। তাহার আসমুদ্রবিস্তৃত। নদীপৰ্বত লোকালয় গোরার চক্ষের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল, অনন্তের দিক হইতে একটি মুক্ত নির্মল আলোক আসিয়া এই ভারতবর্ষকে সর্বত্র যেন জ্যোতির্ময় করিয়া দেখাইল । গোরার বক্ষ ভরিয়া উঠিল, তাহার দুই চক্ষু জ্বলিতে লাগিল, তাহার মনের কোথাও লেশমাত্র নৈরাশ্য রহিল না। ভারতবর্ষের যে কাজ অন্তহীন, যে কাজের ফল বহুদূরে তাহার জন্য তাহার প্রকৃতি আনন্দের সহিত প্ৰস্তুত হইল- ভারতবর্ষের যে মহিমা সে ধ্যানে দেখিয়াছে তাহাকে নিজের চক্ষে দেখিয়া যাইতে পরিবে না বলিয়া তাহার কিছুমাত্র ক্ষোভ রহিল না। সে মনে মনে বার বার করিয়া বলিল, 'মা আমাকে ডাকিতেছেন- চলিলাম যেখানে অন্নপূর্ণা, যেখানে জগদ্ধাত্রী বসিয়া আছেন সেই সুদূরকালেই অথচ এই নিমেষেই, সেই মৃত্যুর পরপ্রান্তেই অথচ এই জীবনের মধ্যেই, সেই-যে মহামহিমান্বিত ভবিষ্যৎ আজ আমার এই দীনহীন বর্তমানকে সম্পূর্ণ সার্থক করিয়া উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছে— আমি চলিলাম সেইখানেই— সেই অতিদূরে সেই অতিনিকটে মা আমাকে ডাকিতেছেন।” এই আনন্দের মধ্যে গোরা যেন বিনয় এবং অবিনাশের সঙ্গ পাইল, তাহারাও তাহার পর হইয়া রহিল না— আদ্যকার সমস্ত ছোটো বিরোধগুলি একটা প্ৰকাণ্ড চরিতার্থতায় কোথায় মিলাইয়া গেল । গোরা যখন আনন্দময়ীর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন তাহার মুখ আনন্দের আভায় দীপ্যমান, তখন তাহার চক্ষু যেন সম্মুখস্থত সমস্ত পদার্থের পশ্চাতে আর-একটি কোন অপরূপ মূর্তি দেখিতেছে। প্রথমেই হঠাৎ আসিয়া সে যেন ভালো করিয়া চিনিতে পারিল না, ঘরে তাহার মা'র কাছে কে বসিয়া আছে । সুচরিতা উঠিয়া দাড়াইয়া গোরাকে নমস্কার করিল। গোরা কহিল, “এই-যে, আপনি এসেছেন— বসূন ।” গোরা এমন করিয়া বলিল “আপনি এসেছেন, যেন সুচরিতার আসা একটা সাধারণ ঘটনার মধ্যে নয়, এ যেন একটা বিশেষ আবির্ভাব । একদিন সুচরিতার সংস্রব হইতে গোরা পলায়ন করিয়াছিল। যতদিন পর্যন্ত সে নানা কষ্ট এবং কােজ লইয়া ভ্ৰমণ করিতেছিল। ততদিন সুচরিতার কথা মন থেকে অনেকটা দূরে রাখিতে পারিয়াছিল। কিন্তু জেলের অবরোধের মধ্যে সুচরিতার স্মৃতিকে সে কোনােমতেই ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই। এমন একদিন ছিল যখন ভারতবর্ষে যে স্ত্রীলোক আছে সে কথা গোরার মনে উদয়ই হয় নাই। এই সত্যটি এতকাল পরে সে সুচরিতার মধ্যে নূতন আবিষ্কার করিল। একেবারে এক মুহুর্তে এতবড়ো একটা পুরাতন এবং প্রকাণ্ড কথাটাকে হঠাৎ গ্রহণ করিয়া তাহার সমগ্ৰ বলিষ্ঠ প্রকৃতি ইহার আঘাতে কম্পিত হইয়া উঠিল। জেলের মধ্যে বাহিরের সূর্যালোক এবং মুক্ত বাতাসের জগৎ যখন তাহার মনের মধ্যে বেদনা সঞ্চার করিত তখন সেই জগৎটিকে কেবল সে নিজের কর্মক্ষেত্র এবং কেবল সেটাকে পুরুষসমাজ বলিয়া দেখিত না ; যেমন করিয়াই সে ধ্যান করিত বাহিরের এই সুন্দর জগৎসংসারে সে