পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ ዓbr . রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছুকলি “গুন যে পদ ! আমি যে গুণগ্ৰাহী এবং আমি যে অকৃতজ্ঞ নই তার সাক্ষ্য প্রমাণ " সুচরিতা কহিল, “ওতে কেবল আপনারই গুণের পরিচয় দিচ্ছেন।” বিনয় কহিল, “আমার গুণের পরিচয় কিন্তু আমার কাছে কিছু পাবেন না। পেতে চান তোমার কাছে আসবেন- স্তম্ভিত হয়ে যাবেন, ওঁর মুখে যখন শুনি আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। মা যদি আমার জীবনচরিত লেখেন তা হলে আমি সকাল সকাল মরতে রাজি আছি।” আনন্দময়ী কহিলেন, “শুনিছ একবার ছেলের কথা !” গোরা কহিল, “বিনয়, তোমার বাপ-মা সার্থক তোমার নাম রেখেছিলেন ।” বিনয় কহিল, “আমার কাছে বোধ হয় তঁরা আর কোনো গুণ প্ৰত্যাশা করেন নি বলেই বিনয় গুণটির জন্যে দোহাই পেড়ে গিয়েছেন, নইলে সংসারে হাস্যাম্পদ হতে হত ।” এমনি করিয়া প্ৰথম আলাপের সংকোচ কাটিয়া গেল । বিদায় লইবার সময় সুচরিতা বিনয়কে বলিল, “আপনি একবার আমাদের ও দিকে যাবেন না ?” সুচরিতা বিনয়কে যাইতে বলিল, গোরাকে বলিতে পারিল না। গোরা তাহার ঠিক অর্থটা বুঝিল না, তাহার মনের মধ্যে একটা আঘাত বাজিল । বিনয় যে সহজেই সকলের মাঝখানে আপনার স্থান করিয়া লাইতে পারে। আর গোরা তাহা পারে না, এজন্য গোরা ইতিপূর্বে কোনোদিন কিছুমাত্র খেদ অনুভব করে নাই— আজি নিজের প্রকৃতির এই অভাবকে অভাব বলিয়া বুঝিল । ( 0. ললিতার সঙ্গে তাহার বিবাহ-প্রসঙ্গ আলোচনা করিবার জন্যই যে সুচরিতা বিনয়কে ডাকিয়া গেল, বিনয় তাহা বুঝিয়াছিল। এই প্রস্তাবটিকে সে শেষ করিয়া দিয়াছে বলিয়াই তো ব্যাপারটা শেষ হইয়া যায় নাই। তাহার যতক্ষণ আয়ু আছে ততক্ষণ কোনো পক্ষের নিস্কৃতি থাকিতে পারে না । এতদিন বিনয়ের সকলের চেয়ে বড়ো ভাবনা ছিল, গোরাকে আঘাত দিব কী করিয়া । গোরা বলিতে শুধু যে গোরা মানুষটি তাহা নহে ; গোরা যে ভাব, যে বিশ্বাস, যে জীবনকে আশ্রয় করিয়া আছে সেটাও বটে । ইহারই সঙ্গে বরাবর নিজেকে মিলাইয়া চলাই বিনয়ের অভ্যাসের এবং আনন্দের বিষয় ছিল ; ইহার সঙ্গে কোনোপ্রকার বিরোধ যেন তাহার নিজেরই সঙ্গে বিরোধ । কিন্তু সেই আঘাতের প্রথম সংকোচটি কাটিয়া গেছে ; ললিতার প্রসঙ্গ লইয়া গোরার সঙ্গে একটা স্পষ্ট কথা হইয়া যাওয়াতে বিনয় জোর পাইল। ফোঁড়া কাটাইবার পূর্বে রোগীর ভয় ও ভাবনার অবধি ছিল না ; কিন্তু অস্ত্র যখন পড়িল তখন রোগী দেখিল বেদনা আছে বটে, কিন্তু আরামও আছে, এবং জিনিসটাকে কল্পনায় যত সাংঘাতিক বলিয়া মনে হইয়াছিল ততটাও নহে । এতক্ষণ বিনয় নিজের মনের সঙ্গে তর্কও করিতে পারিতেছিল না, এখন তাহার তর্কের দ্বারাও খুলিয়া গেল। এখন মনে মনে গোরার সঙ্গে তাহার উত্তর-প্রত্যুত্তর চলিতে লাগিল । গোরার দিক হইতে যে-সকল যুক্তিপ্রয়োগ সম্ভব সেইগুলি মনের মধ্যে উত্থাপিত করিয়া তাহাদিগকে নানা দিক হইতে খণ্ডন করিতে লাগিল। যদি গোরার সঙ্গে মুখে মুখে সমস্ত তর্ক চলিতে,পারিত তাহা হইলে উত্তেজনা যেমন জাগিত তেমনি নিবৃত্ত হইয়াও যাইত ; কিন্তু বিনয় দেখিল, এ বিষয়ে গোরা শেষ পর্যন্ত তর্ক করিবে না । ইহাতেও বিনয়ের মনে একটা উত্তাপ জাগিল ; সে ভাবিল— গোরা বুঝিবে না, বুঝাইবে না, কেবলই জোর করিবে । ‘জোর ! জোরের কাছে মাথা হেঁট করিতে পারিব না।” বিনয় কহিল, “যাহাঁই ঘটুক আমি সত্যের পক্ষে । এই বলিয়া সত্য' বলিয়া একটি শব্দকে দুই হাতে সে বুকের মধ্যে আঁকড়িয়া ধরিল । গোরার প্রতিকুলে একটি খুব প্রবল পক্ষকে দাড় করানো দরকারএইজন্য, সত্যই যে বিনয়ের চরম অবলম্বন ইহাই সে বার বার করিয়া নিজের মনকে বলিতে লাগিল । এমন-কি, সত্যকেই সে যে আশ্রয় করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া নিজের প্রতি তাহার ভারি একটা শ্ৰদ্ধা জন্মিল। এইজন্য বিনয় অপরাহুে সুচরিতার বাড়ির দিকে যখন গেল তখন বেশ একটু