পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ○ br○ এ পথও ভালোবাসে ও পথও ভালোবাসে, কোনোটা হইতেই নিজেকে বঞ্চিত করিতে পারে না, সে গমস্থান হইতেই বঞ্চিত হয়— সে কেবল পথের কুকুরের মতোই ঘুরিয়া বেড়ায় । ব্যাধি নিরূপণ করা কঠিন, কিন্তু নিরূপণ হইলেই যে তাহার প্রতিকার করা সহজ হয় তাহা নহে। বিনয়ের বুঝিবার শক্তি খুব তীক্ষা, করিবার শক্তিরই অভাব ; এইজন্য এ পর্যন্ত সে নিজের চেয়ে প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বন্ধুর প্রতিই নির্ভর করিয়া আসিয়াছে। অবশেষে অত্যন্ত সংকটের সময় আজ সে হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছে ইচ্ছাশক্তি নিজের না থাকিলেও ছোটােখাটাে প্রয়োজনে ধারে-বরাতে কাজ চালাইয়া লওয়া যায়, কিন্তু আসল দরকারের বেলায় পরের তহবিল লইয়া কোনোমতেই কারবার চলে ନୀ ! সূর্য হেলিয়া পড়িতেই যেখানে ছায়া ছিল সেখানে রৌদ্র আসিয়া পড়িল। তখন তরুতল ছাড়িয়া আবার রাস্তায় বাহির হইল। কিছু দূরে যাইতেই হঠাৎ শুনিল, “বিনয়বাবু! বিনয়বাবু!” পরীক্ষণেই সতীশ আসিয়া তাহার হাত ধরিল। বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করিয়া সতীশ তখন বাড়ি ফিরিতেছিল। সতীশ কহিল, “চলুন, বিনয়বাবু, আমার সঙ্গে বাড়ি চলুন ।” বিনয় কহিল, “সে কি হয় সতীশবাবু ?” সতীশ কহিল, “কেন হবে না ?” বিনয় কহিল, “এত ঘন ঘন গেলে তোমার বাড়ির লোকে আমাকে সহ্য করতে পারবে কেন ?” সতীশ বিনয়ের এই যুক্তিকে একেবারে প্রতিবাদের অযোগ্য জ্ঞান করিয়া কেবল কহিল, “না, চলুন।” তাহাদের পরিবারের সঙ্গে বিনয়ের যে সম্বন্ধ আছে সেই সম্বন্ধে যে কতবড়ো একটা বিপ্লব ঘটিয়াছে তাহা বালক কিছুই জানে না, সে কেবল বিনয়কে ভালোবাসে, এই কথা মনে করিয়া বিনয়ের হৃদয় অত্যন্ত বিচলিত হইল। পরেশবাবুর পরিবার তাহার কাছে যে-একটি স্বৰ্গলোক সৃষ্টি করিয়াছিল তাহার মধ্যে কেবল এই বালকটিতেই আনন্দের সম্পূর্ণতা অক্ষুন্ন আছে ; এই প্রলয়ের দিনে তাহার চিত্তে কোনো সংশয়ের মেঘ ছায়া ফেলে নাই, কোনো সমাজের আঘাত ভাঙন ধরাইতে চেষ্টা করে নাই । प्रिट् ।" সতীশের জীবনে শিশুকাল হইতে সুচরিতা ও ললিতার যে স্নেহ ও আদর সঞ্চিত হইয়া আছে সতীশকে বাহুদ্বারা বেষ্টন করিয়া বিনয় যেন সেই মাধুর্যের স্পর্শ লাভ করিল। সমস্ত পথ সতীশ যে বহুতর অপ্রাসঙ্গিক কথা অনর্গল বকিয়া গেল তােহা বিনয়ের কানে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল। বালকের চিত্তের সরলতার সংস্রবে। তাহার নিজের জীবনের জটিল সমস্যাকে কিছুক্ষণের জন্য সে একেবারে ভুলিয়া থাকিতে পারিল । পরেশবাবুর বাড়ির সম্মুখ দিয়াই সুচরিতার বাড়ি যাইতে হয়। পরেশবাবুর একতলার বসিবার ঘর রাস্ত হইতেই দেখিতে পাওয়া যায়। সেই ঘরের সম্মুখে আসিতেই বিনয় সে দিকে একবার মুখ না তুলিয়া থাকিতে পারিল না । দেখিল তাহার টেবিলের সম্মুখে পরেশবাবু বসিয়া আছেন— কোনো কথা কহিতেছেন কি না বুঝা গেল না ; আর ললিতা রাস্তার দিকে পিঠ করিয়া পরেশবাবুর চৌকির কাছে একটি ছোটাে বেতের মোড়ার উপর ছাত্রীটির মতো নিস্তব্ধ হইয়া আছে। সুচরিতার বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে ক্ষোভে ললিতার হৃদয়কে অসহ্যরূপে অশান্ত করিয়া তুলিয়াছিল। সে তাহা নিবৃত্ত করিবার আর-কোনো উপায়ই জানিত না, সে তাই আস্তে আস্তে পরেশবাবুর কাছে আসিয়া বসিয়াছিল। পরেশবাবুর মধ্যে এমনি একটি শান্তির আদর্শ ছিল যে অসহিষ্ণু ললিতা নিজের চাঞ্চল দমন করিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার কাছে আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত। পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘কী ললিতা ?’ ললিত কহিত, ‘কিছু নয় বাবা ! তোমার এই ঘরটি বেশ ঠাণ্ডা ।” আজি ললিতা আহত হৃদয়টি লইয়া তাহার কাছে আসিয়াছে তাহা পরেশবাবু স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন । তাহার নিজের মধ্যেও একটি বেদনা প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল। তাই তিনি ধীরে ধীরে এমন একটি কথা