পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (፩br6ነ বলে প্রমাণ করে বেড়িয়েছি। যতই প্রমাণ করা শক্ত হয়েছে ততই প্রমাণ করে অহংকার বোধ করেছি। কোনোদিন আমার মনে ধর্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ সত্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে কি না তা আজও আমি বলতে পারি। নে কিন্তু অনুকুল অবস্থা এবং দৃষ্টাস্তের মধ্যে পড়লে সে দিকে আমার অগ্রসর হবার সম্ভাবনা আছে। এ কথা নিশ্চিত । অন্তত যে জিনিস ভিতরে ভিতরে আমার বুদ্ধিকে পীড়িত করে, চিরজীবন তারই জয়পতাকা বহন ক’রে বেড়াবার হীনতা থেকে উদ্ধার পাব ।” পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতেই বিনয় নিজের বর্তমান অবস্থার অনুকূল যুক্তিগুলিকে আকার দান করিয়া তুলিতে লাগিল । এমনি উৎসাহের সঙ্গে করিতে লাগিল যেন অনেক দিনের তর্কবিতর্কের পর সে এই স্থির সিদ্ধান্তে আসিয়া দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। তবু পরেশবাবু তাহাকে আরো কিছুদিনের সময় লইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন । তাহাতে বিনয় ভাবিল তাহার দৃঢ়তার উপর পরেশবাবুর বুঝি সংশয় আছে। সুতরাং তাহার জেদ ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তাহার মন যে একটি নিঃসন্দিগ্ধ ক্ষেত্রে আসিয়া দাড়াইয়াছে, কিছুতেই তাহার আর কিছুমাত্র হেলিবার টলিবার সম্ভাবনা নাই, ইহাই বার বার করিয়া জানাইল । উভয় পক্ষ হইতেই ললিতার সঙ্গে বিবাহের কোনো প্রসঙ্গই উঠিল না | এমন সময় গৃহকর্ম-উপলক্ষে বরদাসুন্দরী সেখানে প্রবেশ করিলেন । যেন বিনয় ঘরে নাই। এমনি ভাবে কাজ সারিয়া তিনি চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিলেন । বিনয় মনে করিয়াছিল, পরেশবাবু এখনই বরদাসুন্দরীকে ডাকিয়া বিনয়ের নূতন খবরটি তাহাকে জানাইবেন । কিন্তু পরেশবাবু কিছুই বলিলেন না । বস্তুত এখনো বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়া তিনি মনেই করেন নাই ! এ কথাটি সকলের কাছেই গোপন রাখিতে তিনি ইচ্ছুক ছিলেন । কিন্তু বরদাসুন্দরী বিনয়ের প্রতি যখন সুস্পষ্ট অবজ্ঞা ও ক্ৰোধ প্রকাশ করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, তখন বিনয় আর থাকিতে পারিল না। সে গমনােন্মুখ বরদাসুন্দরীর পায়ের কাছে মাথা নত করিয়া প্ৰণাম করিল এবং কহিল, “আমি ব্ৰাহ্মসমাজে দীক্ষা নেবার প্রস্তাব নিয়ে আজ। আপনাদের কাছে এসেছি । আমি অযোগ্য, কিন্তু আপনারা আমাকে যোগ্য করে নেবেন এই আমার ভরসা ।” 萨 শুনিয়া বিস্মিত বরদাসুন্দরী ফিরিয়া দাড়াইলেন এবং ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিয়া বসিলেন । তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পারেশবাবুর মুখের দিকে চাহিলেন । পরেশ কহিলেন, “বিনয় দীক্ষা গ্ৰহণ করবার জন্যে অনুরোধ করছেন।” শুনিয়া বরদাসুন্দরীর মনে একটা জয়লাভের গর্ব উপস্থিত হইল বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ আনন্দ হইল না। কেন ? তাহার ভিতরে ভিতরে ভারি একটা ইচ্ছা হইয়াছিল, এবার যেন পরেশবাবুর রীতিমত একটা শিক্ষা হয়। তাহার স্বামীকে প্রচুর অনুতাপ করিতে হইবে এই ভবিষ্যদবাণী তিনি খুব জোরের সঙ্গে বার বার ঘোষণা করিয়াছিলেন । সেইজনা সামাজিক আন্দোলনে পরেশবাবু যথেষ্ট বিচলিত হইতেছিলেন না দেখিয়া বরদাসুন্দরী মনে মনে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিলেন। হেনকালে সমস্ত সংকটের এমন সুচারুরূপে মীমাংসা হইয়া যাইবে ইহা বরদাসুন্দরীর কাছে বিশুদ্ধগ্ৰীতিকর হয় নাই । তিনি মুখ গভীর করিয়া কহিলেন, “এই দীক্ষার প্রস্তাবটা আর কিছুদিন আগে যদি হত তা হলে আমাদের এত অপমান এত দুঃখ পেতে হত না ।” পরেশবাবু কহিলেন, “আমাদের দুঃখকষ্ট-অপমানের তো কোনো কথা হচ্ছে না, বিনয় দীক্ষা নিতে চাচ্ছেন ৷” दलनाशूनी पलिशा उठिलन, "९५ मैीका ?” বিনয় কহিলেন, “অন্তর্যামী জানেন আপনাদের দুঃখ-অপমান সমস্তই আমার ।” পরেশ কহিলেন, “দেখো বিনয়, তুমি ধর্মে দীক্ষা নিতে যে চাচ্ছি সেটাকে একটা অবান্তর বিষয় কোরো না। আমি তোমাকে পূর্বেও একদিন বলেছি, আমরা একটা কোনাে সামাজিক সংকটে পড়েছি কল্পনা করে তুমি কোনো গুরুতর ব্যাপারে প্রবৃত্ত হােয়ে না।” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু তাও বলি, আমাদের সকলকে জালে জড়িয়ে