পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা じ○> প্রয়োজন নয়। তোমাদের ভাবী বংশের মধ্যে যে দূরব্যাপী ভবিষ্যৎ রয়েছে তার ভার যার উপরে স্থাপিত, সেই তোমাদের সমাজ- তার কথা কি ভাববে না ?” পারেশবাবু কহিলেন, “হিন্দুসমাজ তােমাদের ভার যদি না নেয়, যদি না স্বীকার করে ?" বিনয় আনন্দময়ীর কথা স্মরণ করিয়া কহিল, “তাকে স্বীকার করাবার ভার আমাদের নিতে হবে । সমাজ হতে পারে !" পরেশবাবু কহিলেন, “মুখের তর্কে একটা জিনিসকে একরকম করে দেখানাে যেতে পারে, কিন্তু কাজে সেরকমটি পাওয়া যায় না। নইলে কেউ ইচ্ছা করে কি পুরাতন সমাজকে ছাড়তে পারে ? যে সমাজ মানুষের ধর্মবোধকে বাহা আচারের বেড়ি দিয়ে একই জায়গায় বন্দী করে বসিয়ে রাখতে চায় তাকে মানতে গেলে নিজেদের চিরদিনের মতো কাঠের পুতুল করে রাখতে হয় ।” বিনয় কহিল, “হিন্দুসমাজের যদি সেই সংকীর্ণ অবস্থাই হয়ে থাকে। তবে সেটা থেকে মুক্তি দেবার ভাৱ আমাদের নিতে হবে ; যেখানে ঘরের জানলা-দরজা বাড়িয়ে দিলেই ঘরে আলো-বাতাস আসে সেখানে কেউ রাগ করে পাকা বাড়ি ভূমিসাৎ করতে চায় না।” ললিতা বলিয়া উঠিল, “বাবা, আমি এ-সমস্ত কথা বুঝতে পারি নে। কোনো সমাজের উন্নতির ভার নেবার জন্যে আমার কোনো সংকল্প নেই। কিন্তু চারি দিক থেকে এমন একটা অন্যায় আমাকে ঠেলা দিচ্ছে যে আমার প্রাণ যেন হাঁপিয়ে উঠছে । কোনো কারণেই এ-সমস্ত সহ করে মাথা নিচু করে থাকা আমার উচিত নয় । উচিত অনুচিতও আমি ভালো বুঝি নে— কিন্তু, বাবা, আমি পারব না।” পরেশবাবু স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “আরো কিছু সময় নিলে ভালো হয় না ? এখন তােমার মন চঞ্চল আছে ।” ললিত কহিল, “সময় নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, অসত্য কথা ও অন্যায় অত্যাচার বেড়ে উঠতেই থাকবে । তাই আমার ভারি ভয় হয়, অসহ্য হয়ে পাছে হঠাৎ এমন কিছু করে ফেলি যাতে তুমিও কষ্ট পাও ৷ তুমি এ কথা মনে কোৱাে না বাবা, আমি কিছুই ভাবি নি। আমি বেশ করে চিন্তা করে দেখেছি যে, আমার যেরকম সংস্কার ও শিক্ষা তাতে ব্ৰাহ্মসমাজের বাইরে হয়তো আমাকে অনেক সংকোচ ও কষ্ট স্বীকার করতে হবে ; কিন্তু আমার মন কিছুমাত্র কুষ্ঠিত হচ্ছে নী, বরঞ্চ মনের ভিতরে একটা জোর উঠছে, একটা আনন্দ হচ্ছে! আমার একটিমাত্র ভাবনা, বাবা, পাছে আমার কোনো কাজে তোমাকে কিছুমাত্র কষ্ট দেয় ।” এই বলিয়া ললিতা আস্তে আস্তে পরেশবাবুর পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল। পরেশবাবু ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “মা, নিজের বুদ্ধির উপরেই যদি আমি একমাত্র নির্ভর করতুম তা হলে আমার ইচ্ছা ও মতের বিরোধে কোনাে কাজ হলে দুঃখ পেতুম। তোমাদের মনে যে আবেগ উপস্থিত হয়েছে সেটা যে সম্পূর্ণ অমঙ্গল সে আমি জোর করে বলতে পারি নে। আমিও একদিন বিদ্রোহ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলুম, কোনাে সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তাই করি নি। সমাজের উপর আজকাল এই-যে ক্রমাগত ঘাত-প্রতিঘাত চলছে এতে বােঝা যাচ্ছে তারই শক্তির কাজ চলছে। তিনি যে নানা দিক থেকে ভেঙে গড়ে শোধন করে কােন জিনিসটাকে কী ভাবে দাঁড় করিয়ে তুলবেন আমি তার কী জানি! ব্ৰাহ্মসমাজই কি আর হিন্দুসমােজই কি, তিনি দেখছেন মানুষকে ।” এই বলিয়া পরেশবাবু মুহূর্তকালের জন্য চােখ বুজিয়া নিজের অন্তঃরণের নিভৃতের মধ্যে নিজেকে যেন স্থির করিয়া লইলেন । কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া পারেশবাবু কহিলেন, “দেখাে বিনয়, ধর্মমতের সঙ্গে আমাদের দেশে সমাজ সম্পূর্ণ জড়িত হয়ে আছে, এইজনে আমাদের সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে ধর্মানুষ্ঠানের যােগ আছে । ধর্মমতের গণ্ডির বাইরের লােককে সমাজের গণ্ডির মধ্যে কােনােমতে নেওয়া হবে না বলেই তাঁর দ্বার রাখা হয় নি, সেটা তােমরা কেমন করে এড়াবে আমি তাে ভেবে পাচ্ছি নে ।