পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○V) রবীন্দ্র-রচনাবলী পরেশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই ঠাণ্ডায় এত রাত্রে ছাতে ?” হরিমোহিনী কহিলেন, “একটু ঠাণ্ডা হয়েই নিক। এখনকার মেয়েদের ঠাণ্ডায় অপকার হবে না।” হরিমোহিনীর মন আজ খারাপ হইয়া গিয়াছে বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সুচরিতাকে খাইতে ডাকেন নাই। সুচরিতারও আজ সময়ের জ্ঞান ছিল না। হঠাৎ স্বয়ং পরেশবাবুকে ছাতে আসিতে দেখিয়া সুচরিতা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিল। কহিল, “বাবা, চলো, নীচে চলো, তোমার ঠাণ্ডা লাগবে ।” ঘরে আসিয়া প্ৰদীপের আলোকে পরেশের উদবিগ্ন মুখ দেখিয়া সুচরিতার মনে খুব একটা ঘা লাগিল। এতদিন যিনি পিতৃহীনার পিতা এবং গুরু ছিলেন, আশৈশবের সমস্ত বন্ধন বিচ্ছিন্ন করিয়া র্তাহার কােছ হইতে কে আজ সুচরিতাকে দূরে টানিয়া লইয়া যাইতেছে ? সুচরিতা কিছুতেই যেন নিজেকে ক্ষমা করিতে পারিল না। পরেশ ক্লান্তভাবে চৌকিতে বসিলে পর দুনিবার অশ্রুকে গোপন করিবার জন্য সুচরিতা তাহার চৌকির পশ্চাতে দাড়াইয়া ধীরে ধীরে তাহার পক্ককেশের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিয়া দিতে লাগিল । পরেশ কহিলেন, “বিনয় দীক্ষা গ্ৰহণ করতে অসম্মত হয়েছেন।” সুচরিতা কোনো উত্তর করিল না। পরেশ কহিলেন, “বিনয়ের দীক্ষাগ্রহণের প্রস্তাবে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল, সেইজন্যে আমি এতে বিশেষ ক্ষুন্ন হই নি— কিন্তু ললিতার কথার ভাবে বুঝতে পারছি দীক্ষা না হলেও বিনয়ের সঙ্গে বিবাহে সে কোনো বাধা অনুভব করছে না।” সুচরিতা হঠাৎ খুব জোরের সহিত বলিয়া উঠিল, “না। বাবা, সে কখনোই হতে পারবে না। কিছুতেই না।” সুচরিতা সচরাচর এমন অনাবশ্যক ব্যগ্রতা প্রকাশ করিয়া কথা কয় না, সেইজন্য তাহার কণ্ঠস্বরে এই আকস্মিক আবেগের প্রবলতায় পরেশ মনে মনে একটু আশ্চর্য হইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হতে পারবে না ?” সুচরিতা কহিল, “বিনয় ব্রাহ্ম না হলে কোন মতে বিয়ে হবে ?” পরেশ কহিলেন, “হিন্দুমতে ।” সুচরিতা সবেগে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “না না, আজকাল এ-সব কী কথা হচ্ছে ? এমন কথা মনেও আনা উচিত নয়। শেষকালে ঠাকুরপুজো করে ললিতার বিয়ে হবে! এ কিছুতেই হতে দিতে পারব न !” গোরা নাকি সুচরিতার মন টানিয়া লইয়াছে, তাই সে আজ হিন্দুমতে বিবাহের কথায় এমন একটা অস্বাভাবিক। আক্ষেপ প্ৰকাশ করিতেছে। এই আক্ষেপের ভিতরকার আসল কথাটা এই যে, পরেশকে সুচরিতা এক জায়গায় দৃঢ় করিয়া ধরিয়া বলিতেছে- “তোমাকে ছাড়িব না, আমি এখনো তোমার সমাজের, তোমার মতের, তোমার শিক্ষার বন্ধন কোনোমতেই ছিড়িতে দিব না।” পরেশ কহিলেন, “বিবাহ-অনুষ্ঠানে শালগ্রামের সংস্রব বাদ দিতে বিনয় রাজি হয়েছে।” সুচরিতা চৌকির পিছন হইতে আসিয়া পরেশের সম্মুখে চৌকি লইয়া বসিল। পরেশ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এতে তুমি কী বল ?” সুচরিতা একটু চুপ করিয়া কহিল, “আমাদের সমাজ থেকে ললিতাকে তা হলে বেরিয়ে যেতে হবে ।” পরেশ কহিলেন, “এই কথা নিয়ে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়েছে। কোনো মানুষের সঙ্গে সমাজের যখন বিরোধ বাধে তখন দুটাে কথা ভেবে দেখবার আছে, দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায় কোন দিকে এবং প্রবল কে । সমাজ প্রবল তাতে সন্দেহ নেই, অতএব বিদ্রোহীকে দুঃখ পেতে হবে। ললিতা বারংবার আমাকে বলছে, দুঃখ স্বীকার করতে সে যে শুধু প্ৰস্তুত তা নয়, এতে সে আনন্দ বোধ করছে। এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে অন্যায় না দেখলে আমি তাকে বাধা দেব কী করে ?” সুচরিতা কহিল, “কিন্তু, বাবা, এ কী রকম হবে ।”