পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ○○お গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “পূর্বেই বা মনের ভােব কী রকম ছিল আর এখনই বা কী রকম হয়েছে জিজ্ঞাসা করি ।” গোরার কথার সুরে বিনয়ের মন আবার একবার যুদ্ধের জন্য কোমর বাধিতে বসিল । সে কহিল, “আগে যখন শুনতুম কেউ ব্রাহ্ম হতে যাচ্ছে মনের মধ্যে খুব একটা রাগ হত, সে যেন বিশেষরূপ শাস্তি পায় এই আমার ইচ্ছা হত ! কিন্তু এখন আমার তা হয় না। আমার মনে হয় মতকে মত দিয়ে, যুক্তিকে যুক্তি দিয়েই বাধা দেওয়া চলে, কিন্তু বুদ্ধির বিষয়কে ক্ৰোধ দিয়ে দণ্ড দেওয়া বর্বরতা।” গোরা কহিল, “হিন্দু ব্ৰাহ্ম হচ্ছে দেখলে এখন আর রাগ হবে না, কিন্তু ব্ৰাহ্ম প্ৰায়শ্চিত্ত করে হিন্দু হতে যাচ্ছে দেখলে রাগে তোমার অঙ্গ জ্বলতে থাকবে, পূর্বের সঙ্গে তোমার এই প্রভেদটা ঘটেছে।” বিনয় কহিল, “এটা তুমি আমার উপর রাগ করে বলছি, বিচার করে বলছি না।” গোরা কহিল, “আমি তোমার পরে শ্রদ্ধা করেই বলছি, এইরকম হওয়াই উচিত ছিল- আমি হলেও এইরকম হত । বহুরূপী যেরকম রঙ বদলায় ধর্মমত গ্রহণ ও ত্যাগ যদি সেইরকম আমাদের চামড়ার উপরকার জিনিস হত তা হলে কোনো কথাই ছিল না, কিন্তু সেটা মর্মের জিনিস বলেই সেটাকে হালকা করতে পারি নি । যদি কোনোরকম বাধা না থাকে, যদি দণ্ডের মাশুল না দিতে হয়, তা হলে গুরুতর বিষয়ে একটা মত গ্রহণ বা পরিবর্তনের সময় মানুষ নিজের সমস্ত বুদ্ধিকে জাগাবে কেন ? সত্যকে যথার্থ সত্য বলেই গ্রহণ করছি কি না মানুষকে তার পরীক্ষা দেওয়া চাই। দণ্ড স্বীকার করতেই হবে । মুলাটা এড়িয়ে রত্নটুকু পাবে সত্যের কারবার এমন শৌখিন কারবার নয়।” তর্কের মুখে আর-কোনো বলগা রহিল না। কথার উপরে কথা বাণের উপরে বাণের মতো আসিয়া পড়িয়া পরস্পর সংঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করিতে লাগিল । অবশেষে অনেকক্ষণ বাগযুদ্ধের পর বিনয় উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “গোরা, তোমার এবং আমার প্রকৃতির মধ্যে একটা মূলগত প্ৰভেদ আছে। সেটা এতদিন কোনোমতে চাপা ছিল— যখনই মাথা তুলতে চেয়েছে। আমিই তাকে নত করেছি, কেননা, আমি জানতুম যেখানে তুমি কোনো পার্থক্য দেখ সেখানে তুমি সন্ধি করতে জান না, একেবারে তলোয়ার হাতে ছুটতে থাক । তাই তোমার বন্ধুত্বকে রক্ষা করতে গিয়ে আমি চিরদিনই নিজের প্রকৃতিকে খর্ব করে এসেছি। আজ বুঝতে পারছি এতে মঙ্গল হয় নি এবং মঙ্গল হতে পারে না ।” গোরা কহিল, “এখন তোমার অভিপ্ৰায় কী আমাকে খুলে বলে ।” বিনয় কহিল, “আজ আমি একলা দাঁড়ালুম। সমাজ বলে রাক্ষসের কাছে প্রতিদিন মানুষ-বলি দিয়ে কোনোমতে তাকে ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে এবং যেমন করে হােক তারই শাসনপাশ গলায় বেঁধে বেড়াতে হবে, তাতে প্ৰাণ থাক আর না-থাক, এ আমি কোনোমতেই স্বীকার করতে পারব না।” গোরা কহিল, “মহাভারতের সেই ব্ৰাহ্মণশিশুটির মতো খড়কে নিয়ে বকাসুর বধ করতে বেরোবে না কি ?” বিনয় কহিল, “আমার খড়কেতে বকাসুর মরবে কি না তা জানি নে, কিন্তু আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবার অধিকার যে তার আছে। এ কথা আমি কোনোমতেই মানব না— যখন সে চিবিয়ে খাচ্ছে उ२ष • ॥' গোরা কহিল, “এ-সমস্ত তুমি রূপক দিয়ে কথা বলছি, বােঝা কঠিন হয়ে উঠছে।” বিনয় কহিল, “বোঝা তোমার পক্ষে কঠিন নয়, মানাই তোমার পক্ষে কঠিন। মানুষ যেখানে স্বভাবত স্বাধীন, ধর্মত স্বাধীন, আমাদের সমাজ সেখানে তার খাওয়া-শোওয়া-বসাকেও নিতান্ত অর্থহীন বন্ধনে বেঁধেছে। এ কথা তুমি আমার চেয়ে কম জান তা নয় ; কিন্তু এই জবরদস্তিকে তুমি জবরদস্তির দ্বারাই মানতে চাও । আমি আজ বলছি, এখানে আমি কারও জোর মানব না । সমাজের দাবিকে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত স্বীকার করব যতক্ষণ সে আমার উচিত দাবিকে রক্ষা করবে। সে যদি আমাকে মানুষ বলে গণ্য না করে, আমাকে কলের পুতুল করে বানাতে চায়, আমিও তাকে ফুলচন্দন দিয়ে পূজা করব না— লোহার কল বলেই গণ্য করব।”